এসএম নাজের হোসাইন: আমাদের দেশের ব্যবসায়ী সম্পর্কে একটি বাক্য প্রচলিত আছে‘তারা মুনাফা শিকারি।’ যেভাবেই হোক তাকে মুনাফা করতেই হবে। যেমনটি বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর দিক থেকেই স্যানিটাইজার, করোনার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও মাস্ক ফার্মেসিগুলো থেকে উধাও হয়। অবশ্য পরে আট-দশগুণ বেশি দামে আবার পাওয়া যাচ্ছিল। তখন তাদের বক্তব্য ছিল, ওষুধ কোম্পানিগুলোর সরবরাহ কমে গেছে এবং চাহিদা বেড়ে গেছে। দাম বেশি দিলে সরবরাহ ঠিক থাকে, আর ন্যায্য দাম দিলে সংকট। বিষয়টি ব্যবসায়িক নীতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়ে গবেষণার দরকার। ঠিক একইভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার সময় বিশ্বব্যাপী নিত্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের সরবরাহে অস্থিরতা শুরু হয়। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউনের কারণে হঠাৎ চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুপারশপগুলোয়ও পণ্য সংকট দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়গুলোয়, যদিও বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে অস্থিরতার ঘটনা বেশ পুরোনো। যখনই দাম বাড়ে তখনই ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাত খাড়া করেন। ব্যবসায়ীদের অনেক অজুহাতের মধ্যে নতুন একটি শব্দ যোগ হলো ‘করোনা’। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা, গবেষক ও গণমাধ্যম থাকলেও সাধারণ ভোক্তাদের পক্ষে বলার জন্য কেউ নেই। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমানে অধিকাংশ করপোরেট হাউস যেমন নিজস্ব গণমাধ্যম খুলে বসেছে, তেমনি সরকারের নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় সংসদেও বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সে কারণেই বাজেট প্রণয়নসহ যেকোনো আলোচনায় ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে, আর ভোক্তাদের বিষয়গুলো সেভাবে আলোচনায় আসছে না। এ সময়ে বিশ্ববাজারে অনেক নিত্যপণ্যের বৈশ্বিক বুকিং দাম কমলেও দেশীয় নানামুখী সংকটে পণ্যের সহজলভ্যতাকে অনিশ্চিত করছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। ফলে চিনি, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, চাল এবং ডালজাতীয় নিত্যপণ্যের পাইকারি ও খুচরা বাজার দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার দিকে যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জে রয়েছে দেশের ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও মোড়কজাতকারী শীর্ষ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কারখানা। কিন্তু প্রথম দিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হটস্পট ঘোষণার পর স্থবির হয়ে গেছে সেখানকার সব কার্যক্রম, যার প্রভাব পড়ে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ লাইনে। সম্প্রতি বন্দরনগরী চট্টগ্রামও করোনা সংক্রমণের হটস্পট হয়ে ওঠায় ব্যাঘাত ঘটছে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের সরবরাহ ব্যবস্থায়। করোনা পরিস্থিতির আগে খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি আমদানি করা মসুর ডাল (অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা) বিক্রি হতো ৪৫-৫০ টাকায়। করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর রোজার শুরুতে মসুরের দাম ৯০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছিল। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। করোনার আগে পাইকারিতে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হতো ৫২ থেকে ৫৩ টাকায়, এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা দরে। মাঝখানে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল ছোলার দাম। যদিও গত রমজান মাসের শুরুতে দামের ক্ষেত্রে কিছুটা ঊর্ধ্বগতি ছিল, কিন্তু রমজান শেষে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণের কারণে দাম স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে।
স্বাভাবিক সময়ে পাইকারি বাজারে সাদা মটরের (ডাবলি) দাম থাকে কেজিপ্রতি ২৮-৩০ টাকার মধ্যে। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকায়। করোনা পরিস্থিতিতে মাঝখানে প্রতি কেজি ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে পণ্যটি। বর্তমানে পাইকারিতে মটর ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৮ টাকায়, যা করোনা পরিস্থিতির শুরুর দিকে ৪৫ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। অথচ স্বাভাবিক সময়ে পাইকারিতে মটর ডাল বিক্রি হয় ৩০-৩২ টাকার মধ্যে। ডালজাতীয় পণ্যের মধ্যে খেসারির চাহিদার প্রায় পুরোটাই দেশে উৎপাদিত হয়। স্বাভাবিক সময়ে পাইকারিতে খেসারির ডাল বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকার মধ্যে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে খেসারির দাম দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বেড়ে ৯৫-৯৬ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। যদিও বর্তমানে কিছুটা কমে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি কেজি মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২৮ থেকে ১৪০ টাকায়। করোনা পরিস্থিতির আগে বাজারে একই মানের ডাল ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ডাল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, আমদানি ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পর করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় সব ধরনের ডালের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। মানুষ শুকনো নিত্যপণ্য হিসেবে চাল ও চিঁড়ার পর ডালের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় ডালের দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল। করোনা পরিস্থিতির এ কয়েক মাসে কিছু ডালের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিশ্ববাজার থেকে মসুর, মুগ, মটর ও ডাবলি আস্ত আমদানির পর ক্র্যাশিং মিলে ভেঙে বা প্রক্রিয়াজাত করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরবরাহ করা হয়। ডালের বৈশ্বিক দাম সহনীয় থাকলেও আমদানির পর ক্র্যাশিং জটিলতায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। তারা বলছেন, প্রায় দুই মাসের বেশি সাধারণ ছুটি ও যানবাহন চলাচল সীমিত থাকায় এবং চাহিদার তুলনায় উৎপাদনে সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন কারণে ডালের দাম লাগামহীন বেড়ে গেছে। রোজার মাঝামাঝিতে কিছুটা কমলেও ফের বাড়তে শুরু করেছে পণ্যগুলোর দাম। গ্রীষ্মকালে ও বর্ষা মৌসুমে সবজির উৎপাদন কমে আসায় ডালে ওপর দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠীর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, কোরবানির মৌসুমকে সামনে রেখে আগামীতে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে ডালের বাজার আরও কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
দেশে খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম জোগানদাতা চালের ক্ষেত্রে ডালের মতো পরিস্থিতি। চলতি বছরের শুরু থেকে দেশে চালের বাজার বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) গড়ে ৫০০ টাকার বেশি বেড়ে যায়। বোরো মৌসুমের ধান কাটার পর দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে এলেও সেটিও যথার্থ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কৃষকের কাছ থেকে যে দামে ধান কেনা হয়েছে, কয়েক হাতে মুনাফার বদলের পরও বাজারে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে। রোজার ঈদের পর চালের বাজার ফের বাড়তে শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহে মানভেদে বস্তাপ্রতি গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে চালের দাম। শুকনা খাদ্যপণ্যের মধ্যে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে চিঁড়ার দাম। স্বাভাবিক সময়ে পাইকারিতে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চিঁড়া বিক্রি হয় এক হাজার ৪০০ টাকার নিচে। এবারে করোনা পরিস্থিতি ও রমজানকে ঘিরে প্রতিবস্তা চিঁড়ার দাম দ্বিগুণ হয়ে দুই হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে আগের চেয়ে কিছুটা কমে এখন প্রতি বস্তা চিঁড়া এক হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
মসলাজাতীয় পণ্যের বাজার সব সময় অস্থির থাকে। যদিও মানুষের ব্যবহার সীমিত থাকায় অনেকেই বিষয়টি আঁচ করতে পারেন না। মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়েছে আদা ও রসুনের বাজার। পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে করোনা পরিস্থিতির আগে আমদানি করা আদা-রসুনের (চীন) দাম ছিল কেজিপ্রতি ৮০-১২০ টাকা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে গত তিন মাসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনা রোগীদের জন্য আদা উপকারীÑএ তথ্যটি প্রচারিত হওয়ার পর থেকে আদা বাজার থেকে উধাও হতে শুরু করে। এ সময় প্রতি কেজি আদার দাম ৩৫০ টাকায় পর্যন্ত পৌঁছে। যদিও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দেখা যায়, ওই আদা আমদানি করা হয়েছিল কেজিপ্রতি ৮০-৯০ টাকায়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রসুনের দামও। প্রতি কেজি রসুনের দাম পৌঁছেছে প্রায় ২০০ টাকায়। তবে বর্তমানে কিছুটা কমে পাইকারিতে প্রতি কেজি আমদানি করা আদা ৯০ থেকে ১০০ ও রসুন ৯০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। একই অবস্থা দেখা গেছে গম থেকে প্রক্রিয়াজাত আদা-ময়দার ক্ষেত্রেও। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে গমের পাইকারি দাম বেড়ে যায়। হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে বেকারি ও খাবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে। এ অবস্থায় আটা-ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ভাবনায় ফেলেছে সাধারণ ভোক্তা, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের। গত দুই মাসে গমের পাইকারি দাম মণপ্রতি ৮০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত (মানভেদে) বাড়লেও আটা-ময়দার দাম বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। সাধারণ ছুটি ঘোষণার এক সপ্তাহ পর বেশ কিছুদিন দেশের বিভিন্ন কোম্পানি আটা ও ময়দার সরবরাহ দিতে পারেনি।
ভোগ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে বৈশ্বিক দামের পার্থক্যটা অনেক বেশি থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন ভোক্তা অধিকার সংগঠক ও খাতসংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তাদের সে বক্তব্য কার কানে পৌঁছে? যেহেতু আমাদের দেশে সরকার ভোগ্যপণ্যের বাজারের জন্য বেসরকারি খাতের ওপর অতিনির্ভরশীল, তাই তারা সময় বুঝে সংকট তৈরি করে জনগণের পকেট কাটতে মাতোয়ারা হয়। সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার লোকজন তখন দেখলেও না দেখার ভান করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরি পরিস্থিতির সময়ে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক চাহিদার কয়েক গুণ বেশি থাকতে হয়। সরকার বারবার আশ্বস্ত করে আমদানি ও মজুত পর্যাপ্ত আছে। কিন্তু তারপরও বাজারে অস্থিরতা ঠেকানো যায় না। আবার সংকট চলাকালে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতিরিক্ত মজুত-প্রবণতার সৃষ্টি হয়। কিছু ব্যবসায়ী ভোক্তাদেরও অনুপ্রাণিত করে থাকেন মজুত করার জন্য। ফলে স্বাভাবিক সময়ের চাহিদার চেয়েও নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং সংস্থাগুলোর তদারকি কমে যাওয়া এবং ব্যক্তি ও সরকারিভাবে ত্রাণ প্রদানে আমদানির পরিবর্তে স্থানীয় বাজারের ওপর অতিনির্ভরশীলতা পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আবার টিসিবির ন্যায্যমূল্যে বিক্রির পণ্যগুলোও স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়। যদিও দেশি চিনিকলের চিনি তাদের তালিকায় থাকে না, যার প্রভাব স্বাভাবিকভাবে বাজারে কিছুটা হলেও পড়ে। তাই বাজার পর্যালোচনার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে আমদানি ও মজুত করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি এবং টিসিবি ও রেশনিংয়ের আওতায় বিতরণের জন্য পণ্যগুলো বহির্বিশ্বের বাজারের ওপর নির্ভর করা দরকার বলে মনে করেন তারা।
ভোগ্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট ও কারসাজির কথা প্রায়ই শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত বাজার সংস্কারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। একসময় ভোগ্যপণ্যের বাজারে ডিও প্রথা ছিল। আর এই ডিও হাত বদলের পর ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে তখন লাভের অঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে যেত। এটি এখন রদ করে পরিবেশক প্রথা চালু করা হয়। তবে এখনও ভোজ্য তেল, চিনিসহ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যবসা মুষ্টিমেয় কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর এ কারণে বৈশ্বিক বাজার যা-ই হোক না কেন, এই শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে পণ্যের দাম নির্ধারণ করবে, সেভাবেই দাম ওঠানামা করবে। চাহিদা ও জোগানের হিসাব নিয়ে সরকারি পর্যায়েও সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ব্যবসায়ীরা তাদের সুবিধামতো করে চাহিদা ও জোগানের তথ্য দিয়ে সরকারকে বারবার বিভ্রান্ত করে। আবার সরকারি বাজার তদারকি কার্যক্রমগুলো অতিমাত্রায় ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় কার্যক্রম ব্যবসায়ীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হলে সাধারণ ভোক্তাস্বার্থ অবশ্যই ক্ষুন্ন হতে বাধ্য। একই সঙ্গে সংকটকালে ভোগ্যপণ্যের বাজারে অতি মুনাফার প্রবণতা রোধ করা এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে মূল্য সমন্বয় করা না গেলেও সাধারণ ভোক্তারা কোনোভাবেই উপকৃত হবে না।
সভা-সেমিনারে ব্যবসায়ীরা মুক্ত বাজার অর্থনীতির কথা বলে জিকির করে থাকেন। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে দেশে আমদানি না হলেও ওই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। কিন্তু আর্ন্তজাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমলে দেশীয় বাজারে তা আর কমে না। তখন তারা বলে থাকেন ক্রয়মূল্য বেশি। সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো এসব সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত দিতে না পারার মূল কারণ ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যে সক্ষমতা ও বৈষম্য ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলেছে। ব্যবসায়ীরা সরকারের মন্ত্রিসভা, সংসদসহ রাজনীতি, গবেষণা ও অর্থনীতি সবকিছুই একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। একসময় গণমাধ্যমগুলো কিছু পেশাদার সাংবাদিকদের মালিকানায় ছিল। এখন সব করপোরেট হাউসের নিজস্ব গণমাধ্যম আছে। ফলে তারা তাদের সুবিধামতো করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। আর ভোক্তারা ক্রমাগতভাবে ক্ষীণ হচ্ছে। করোনা সংকটে ভোক্তাদের সক্ষমতা আরও দুর্বল হচ্ছে। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমাগতভাবে দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যা ছিল, তা আরও দুর্বল হচ্ছে। ভোগ্যপণ্যের বাজার, অর্থনীতি, ব্যাংকিং সেক্টর, মুদ্রানীতি, বাজার ব্যবস্থা, কৃষি, উৎপাদনÑসবকিছুতে ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া আধিপত্যের পাশাপাশি ভোক্তাদের সক্রিয় ও সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা কমবে না। তাই এখনই সময় সাধারণ ভোক্তার স্বার্থ গুরুত্বসহ বিবেচনা করে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধান করা। তাহলেই আমাদের ভোগ্যপণ্যের অস্থিরতাসহ সব বিষয়ে স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
cabbd.nazer@gmail.com