Print Date & Time : 10 September 2025 Wednesday 2:39 pm

কর্মজীবী মায়ের শিশুর নিরাপত্তায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন

মনোজিৎ মজুমদার:নাতাশা এবার ঢাকার একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি হয়েছে। বয়স চার। মা-বাবা দু’জনেই চাকরি করেন। স্কুল থেকে ফিরে নাতাশার সময় কাটে গৃহকর্মীর সঙ্গে। বাসার কাছেই স্কুল, গৃহকর্মীই নাতাশাকে আনা-নেয়া করেন। অথচ নাতাশার সহপাঠী জারিনকে প্রতিদিন ওর মা স্কুলে আনা-নেয়া করেন। গৃহকর্মীর সঙ্গে স্কুলে যেতে নাতাশার একদম ভালো লাগে না। তার মনে ভীষণ কষ্ট। মায়ের সান্নিধ্য ছাড়া তার সময় কাটতে চায় না। বিকেল হলেই মা-বাবার বাসায় ফেরার অপেক্ষায় থাকে নাতাশা। কল বেলের শব্দ শোনামাত্রই খুশিতে মেতে ওঠে, এই বুঝি মা এলো। দৌড়ে নিজেই দরজা খুলেই মাকে জড়িয়ে ধরে। মা সময়মতো ফিরলেও বাবার অফিস থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়। কোনো কোনোদিন নাতাশা ঘুমিয়ে পড়ে, রাতে বাবার দেখাই হয় না। 

শহরে একাকী শিশুও সংখ্যা কম নয়। নারীশিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কর্মজীবী মায়ের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। শহরগুলোয় যৌথ পরিবার নেই বললেই চলে। একক পরিবারে চাকরিজীবী মা-বাবার শিশুর একমাত্র অবলম্বন বাসার গৃহকর্মী অথবা শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র। নগরজীবনের ব্যস্ততা মা-বাবার সাহচর্য থেকে শিশুদের বঞ্চিত করছে। এ জটিলতা প্রকট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সন্তানের এই একাকিত্ব তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্য-সংক্রান্ত সর্বশেষ ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে নারীর হার ২৯ শতাংশ। বর্তমানে দেশে মোট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন প্রায় ১৫ লাখ। এর মধ্যে নারী ৪ লাখ ১৪ হাজারের বেশি। চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়তে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা ও উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। কর্মজীবী মায়ের সন্তানদের জন্য সেই তুলনায় মানসম্মত শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র গড়ে উঠছে না। বিশ্বস্ত গৃহকর্মীর অভাব এবং সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে কোনো কোনো মা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

এ প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালে হাইকোর্টের একটি আদেশে বলা হয়েছে, কোনো অফিসে ৪০ জন বা এর বেশি নারী কর্মরত থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশুসন্তান থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। কিন্তু যে অফিসে ৪০ জনের কম নারী কর্মরত; তাদের সন্তানের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। আবার শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র থেকে যদি কোনো শিশু হারিয়ে যায়, সে ক্ষেত্রেও এ আদেশে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। 

এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ জুন, ‘শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র আইন, ২০২১’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এ আইনে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র থেকে কোনো শিশু হারিয়ে গেলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। এ আইন প্রবর্তনের ফলে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজ ব্যবস্থাপনায় শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপন ও সরকারি নিবন্ধন সনদ নিয়ে পরিচালনা করতে পারবে। আইনে আরও বলা হয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুও প্রয়োজনীয় সেবা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা, চিকিৎসা, বিনোদন, শিক্ষা ও শিশুর জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি তিন মাসে একবার করে শিশুর অভিভাবকের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। সরকারের অনুমোদন ছাড়া কেউ শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র পরিচালনা করলে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং দশ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ থেকে এ আইনটি কার্যকর হয়েছে। ‘শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র আইন, ২০২১’ প্রণয়নের আগে বেসরকারিভাবে যেসব শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র পরিচালিত হতো সেগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এর আগে ‘শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র বিধিমালা, ২০২১’-এর খসড়া প্রস্তুত করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রে শিশুর সংখ্যা হবে ৩০ জন; তবে স্থান সংকুলানসাপেক্ষে ৬০ জন হতে পারে। শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রের আয়তন সর্বনি¤œ ৩ হাজার বর্গফুট হতে হবে। শিশু যেন বাইরে যেতে না পারে সে জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকতে হবে; ভবনে লিফট না থাকলে সর্বোচ্চ ৪র্থ তলা, লিফট থাকলে সর্বোচ্চ ৭ম তলায় শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে। প্রতিটি শিশুর জন্য ৫০ বর্গফুট হারে (শিশুর উপযোগী খেলাধুলা, খাবার, পড়াশোনা, ব্যায়াম ও ঘুমানোর জন্য থাকতে হবে); ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার থাকতে হবে। শিশুর বয়স অনুযায়ী তিন বেলা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন করতে হবে। শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রের প্রবেশপথ প্রশস্ত, সমতল, আলোকিত এবং শিশুদের উপযোগী হতে হবে; কেন্দ্রে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের যথাযথ ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বেসরকারি পর্যায়ে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাকে এইচএসসি পাস এবং ব্যাংক হিসাবে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা থাকতে হবে, নিবন্ধন ফি হবে ১০ হাজার টাকা। মাসিক ফি দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে হতে হবে। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সেবামূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি শিশুর ভর্তি ফি ৫০০ টাকা, মাসিক ফি দুই হাজার টাকার মধ্যে থাকতে হবে। চার মাস থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুর জন্য কর্মজীবী মা-বাবা/অবিভাবক নির্ধারিত ফরম ভর্তির আবেদন করতে পারবে। ‘শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র বিধিমালা, ২০২১’-এর আওতায় আইনটি পরিচালিত হবে।

বাংলাদেশে প্রথম শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। ইউনিসেফ জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলায় এটি প্রতিষ্ঠা করে। নব্বইয়ের দশকে দেশে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠতে শুরু করে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র গড়ে তোলেন। বাংলাদেশে বর্তমানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১১৯টি এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০টি শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তরের আওতায় আরও বেশি কিছু শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশে বেসরকারি পর্যায়ে কী পরিমাণ শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে; তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। পোশাক শিল্পকারখানায় প্রায় আড়াই হাজার শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকা যেমনÑগুলশান, উত্তরা, ধানমন্ডি, বনশ্রী, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, ইস্কাটন, রাজারবাগ, শ্যামলী, মিরপুর, পল্লবী, বসুন্ধরা, খিলগাঁও, মহাখালী, সেগুনবাগিচা এবং লালমাটিয়ায় বেসরকারিভাবে মানসম্মত শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে। ঢাকার বাইরেও বড় বড় শহরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ভালো মানের শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র গড়ে উঠছে।

শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র স্থাপন কর্মজীবী মা-বাবার জন্য স্বস্তির খবর। শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রে একটি শিশু অন্য শিশুদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়। একাকিত্বে ভোগে না। শিশুর সামাজিকীকরণ হয়। শহরে একাকী শিশুর অবসর কাটে টিভি দেখে, মোবাইলে গেমস খেলে। কায়িক পরিশ্রমের খেলাধুলা না করার কারণে শহুরে শিশুদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা সমস্যা বাড়ছে, যা তাদের পরবর্তী সুস্থ জীবনের জন্য অন্তরায়। এ বাস্তবতায় ‘শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র আইন, ২০২১’ প্রণয়ন সরকারের চমৎকার উদ্যোগ।

এই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন হলে শিশুরা শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রেই খেলাধুলা, বিনোদন, চিকিৎসা এবং শিক্ষার সুযোগ পাবে। শিশুর নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। কর্মজীবী মা-বাবাকে তাদের সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা অনেকটাই লাঘব হবে। তবে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে মা-বাবার সান্নিধ্য অত্যন্ত প্রয়োজন। ব্যস্ততার মাঝেও শিশুকে সময় দিতে হবে। সময় করে শিশুকে নিয়ে দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসতে হবে। একাকিত্ব যেন কোনো শিশুর বিপর্যয়ের কারণ না হয়, তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।

 পিআইডি নিবন্ধ