কসোভোর যুদ্ধ, ব্লান্টের নৈতিকতা ও তার সংগীত জীবন

 

সুমাইয়া মুমতাহানা চৌধুরী: গায়ক জেমস ব্লান্টের নাম আমরা শুনেছি। তার ‘ইউ আর বিউটিফুল’ গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর পাশাপাশি তার ‘অ্যানি’ গানটিও শুনেছেন অনেকে। এই শিল্পী যে একজন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন, তা জানা নেই অনেকেরই।

২০০২ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি সঙ্গীত জগতে সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করেন। জেমস ব্লান্ট ন্যাটোর হয়ে কসোভোতে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৯৯ সালে। সেই সালেরই এক ঘটনার কারণে তিনি আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছিলেন বিশ্বব্যাপী। ব্লান্ট ছিলেন ব্রিটিশ ক্যাভিলারি রেজিমেন্টের একজন কর্মকর্তা। ১৯৯৯ সালে ন্যাটো বাহিনীর হয়ে কসোভোতে দায়িত্ব পালন করতে যান। তখন তিনি ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। তার ইউনিটের কাজ ছিল ম্যাকডোনিয়া-যুগোস্লাভিয়া সীমান্তে অবস্থান নিয়ে সার্বীয় সেনাদের প্রতিহত করা। একদিন ইউনিটটির দায়িত্ব পড়লো প্রিস্টিনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি দখলে আনার। কিন্তু তার ইউনিট সেখানে পৌঁছানোর আগেই এয়ারপোর্টটির দখল নিয়ে নেয় রাশিয়ার সেনাবাহিনী। তখন সেই অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা ন্যাটোর মার্কিন জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক নির্দেশ দেন রাশিয়ান আর্মিকে আক্রমণ করে বিমানবন্দরটির দখল নেয়ার। ব্লান্টের ইউনিটের প্রধান ছিলেন ব্লান্ট নিজেই। তার সঙ্গে ছিল ন্যাটোর ৩০ হাজার সৈন্য। ইচ্ছে করলেই রাশিয়ানদের আক্রমণ করে প্রিস্টিনা বিমানবন্দরটির দখল নিতে পারতেন ব্লান্ট। কেননা সেখানে রাশিয়ানদের ছিল মাত্র দুইশ’র মতো সেনা। কিন্তু ব্লান্ট তার ঊর্ধ্বতন জেনারেলের আদেশ অমান্য করে রাশিয়ানদের আক্রমণ করলেন না। কারণ হিসেবে তিনি পরে বলেছিলেন, তার বিবেক রাশিয়ানদের আক্রমণ করতে সায় দেয়নি। সে সময় রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করলে সেটি পক্ষান্তরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হতো। শুরু হতো রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি। ব্লান্টের ভাষায়, সেটি হতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার ভাষ্যমতে, রাশিয়ানদের সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনো বিরোধ ছিল না। শুধু দখলের নেশা থেকে এভাবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করাটায় তার বিবেক বাধা দিয়েছিল। জেনারেলের আদেশ অমান্য করায় কোর্ট মার্শাল মেনে নিতেও তার আপত্তি ছিল না। ব্লান্ট বলেছিলেন, মার্কিন জেনারেল ক্লার্ক রেডিওতে যখন রাশিয়ানদের আক্রমণ করার আদেশ দিচ্ছিলেন, তখন তার কথা ব্লান্টের ভালো লাগেনি। জেনারেল ক্লার্ক নাকি এও বলেছিলেন, ওদের ধ্বংস করে দাও। ব্লান্ট এখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার গন্ধ পেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার রাজনৈতিক শত্রুতা তো সর্বজনবিদিত। তাই মার্কিন জেনারেলের রাজনৈতিক পদক্ষেপ অনুসরণ

করেননি ক্যাপ্টেন ব্লান্ট। এ ঘটনায় ব্লান্ট অবশ্য তার নিজ দেশ অর্থাৎ ব্রিটেনের জেনারেল মাইক জ্যাকসনের সমর্থন পেয়েছিলেন। জেনারেল জ্যাকসন বলেছিলেন,”আমি আমার সৈন্যদের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইন্ধনের জোগানদাতা হিসেবে দেখতে চাই না।”

এবার আসুন ব্লান্টের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কিছু জেনে নিই। ব্লান্টের আসল নাম জেমস হিলিয়ার ব্লান্ট। তার জš§ ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বাবা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিমান কোরের একজন কর্নেল ছিলেন। সে কারণে ব্লান্টের জš§ হয় উইল্টশায়ারের একটি মিলিটারি হাসপাতালে। ব্লান্টের বাবা সব সময় চাইতেন, তার ছেলেও তার মতো সেনাবাহিনীতে যোগ দিক। ব্লান্টের বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট। তিনি ছেলেকে ছোটবেলা থেকেই বিমান চালনায় আগ্রহী করার চেষ্টা করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ব্লান্ট লাইসেন্স লাভ করেন পাইলট হিসেবে। জেমস ব্লান্টের বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ বহন করে সেনাবাহিনী। তাদের অর্থায়নেই ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলে অ্যারোস্পেস প্রকৌশল বিষয়ে ভর্তি হন ব্লান্ট। কিছুদিন পরে অবশ্য তিনি বিভাগ পরিবর্তন করে সমাজবিদ্যায় চলে আসেন। অতঃপর

১৯৯৬ সালে সমাজবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করেন। সেনাবাহিনীর অর্থায়নে পড়াশোনা করার শর্ত ছিল, কমপক্ষে চার বছর বাহিনীতে কাজ করতে হবে। ব্লান্ট বলেন, বাবার জোরাজুরিতেই আর্মিতে যান তিনি। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাউজহোল্ড ক্যাভিলারির লাইফ গার্ডস ইউনিটে কমিশন লাভ করেন। সেখানেই একসময় ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পান।

আসলে সামরিক বাহিনীর কাজ পছন্দ ছিল না ব্লান্টের। বাবার কথায়ই তিনি ওখানে প্রবেশ করেছিলেন। অস্ত্রের চেয়ে তার বেশি পছন্দ ছিল গিটার। ন্যাটোর হয়ে কসোভোতে কাজ করার সময় তিনি প্রায়ই ট্যাংকের পাশে গিটার নিয়ে বসে পড়তেন। কসোভোর অতিথিপরায়ণ স্থানীয়দের সঙ্গে যখন ন্যাটোর সৈন্যরা খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতো, তখন সেখানে গিটার বাজিয়ে গান গাইতেন ব্লান্ট। তিনি ‘নো ব্রেভারি’ গানটি রচনা করেন কসোভোর যুদ্ধেক্ষেত্রে বসেই।

অবশেষে ২০০২ সালে ব্লান্ট সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। পুরোপুরি সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন। আসলে ব্লান্টের সঙ্গীত জীবন বাল্যকালেই শুরু হয়েছিল। ছোটবেলায় স্কুলে থাকতে তিনি পিয়ানো ও ভায়োলিন বাজানো শিখেছিলেন। বন্ধুদের কাছ থেকে শিখেছিলেন গিটার। ১৪ বছর বয়স থেকেই তিনি নিয়মিত বাদ্যযন্ত্র বাজানো ও গান লেখা শুরু করেন। এমনকি ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলে সমাজবিদ্যায় পড়ার সময় তার আন্ডারগ্র্যাজুয়েট থিসিসের বিষয় ছিল পপ মিউজিক। ২০০৪ সালে তার প্রথম অ্যালবাম ‘ব্যাক টু বেডলাম’ বের হয়। এছাড়া অ্যালবামের বাইরের ‘ইউ আর বিউটিফুল’ ও ‘গুডবাই মাই লাভার’এ সিঙ্গেল দুটি তাকে ২০০৫ সালে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

সঙ্গীতের পাশাপাশি ব্লান্ট আর্তমানবতার সেবায় কাজ করছেন। ১৯৯৯ সালে কসোভোতে থাকাকালে তিনি যুদ্ধকালীন চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী সংগঠন ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর সঙ্গে পরিচিত হন। তখন থেকেই সংগঠনটির প্রতি সমর্থন জানান। পরবর্তী সময়ে তিনি তার কনসার্ট থেকে অর্থ উত্তোলন করে সংগঠনটিতে দান করেন।

জেমস ব্লান্টের একটি উক্তি দিয়ে শেষ There are things that you do along the way that you know are right, and those that you absolutely feel are wrong, that I think itÕs morally important to stand up against, and that sense of moral judgment is drilled into us as soldiers in the British army. (চলার পথে এমন অনেক কিছুই আছে যাকে আমরা আপাতদৃষ্টিতে ঠিক মনে করি, কিন্তু মন থেকে অনুভব করি তা আসলে ভুল। আমি নৈতিকভাবে মনে করি, এ ধরনের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া উচিত এবং এ নীতিবোধ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে গেঁথে দিয়েছে।)”