কাজে আসছে না কোটি টাকার পাতকুয়া

প্রতিনিধি, রাজশাহী: রাজশাহীর বেশ কয়েকটি এলাকা খরাপ্রবণ হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের সেচ সুবিধার জন্য ২০১৮ সালে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এর অধীনে জেলার তিনটি উপজেলায় নির্মাণ করা হয় সৌরবিদ্যুৎচালিত ২০টি পাতকুয়া (ডাগওয়েল)। সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি পাতকুয়ার জন্য খরচ হয়েছে ১৩ লাখ টাকা। সে হিসেবে দুই কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ পাতকুয়াগুলো থেকে মিলছে না কাক্সিক্ষত সেচ সুবিধা। কাজে আসছে না কৃষকের। ফলে পাতকুয়া নির্মাণের এ সিদ্ধান্ত সরকারি টাকা অপচয়ের অভিনব কৌশল হিসেবে দেখছেন কৃষকরা।

রাজশাহী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর প্রান্তিক কৃষকের সেচ সুবিধার জন্য ২০১৮ সালে প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের নাম ‘রাজশাহী জেলার বাঘা, চারঘাট ও পবা উপজেলায় জলাবদ্ধতা নিরসন এবং ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ প্রকল্প’। সে বছর অক্টোবরে শুরু হয় এর কাজ। সম্পূর্ণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সৌর বিদ্যুৎচালিত ২০টি পাতকুয়া স্থাপন করা হয় দুই কোটি ৬০ লাখ টাকায়।

তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করে রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘সুপারস্টার রিনিউ কেব্ল এনার্জি লিমিটেড’। কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও বিন্দুমাত্র অনিয়ম হয়নি বলে দাবি বিএমডিএর। সংশ্লিষ্টদের দাবি, পাতকুয়াগুলো ভূ-উপরিস্থ পানির সংরক্ষণ, সেচ কাজে ব্যবহার ও ভূ-গর্ভস্থ পানির রিচার্জ বাড়াতে সহায়তা করছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পবা উপজেলার সবকটি পাতকুয়া কৃষকের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ। প্রতিটি পাতকুয়া থেকে দুজনেরও সুবিধা মিলছে না। সে সঙ্গে উদ্বোধনের চার মাস পরও সুবিধাভোগীদের কমিটি গঠিত হয়নি। এলাকার প্রভাবশালীরা নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে পাতকুয়া ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ একাধিক কৃষকের।

সূত্র জানায়, এ মাসে প্রকল্পের মেয়াদ হচ্ছে। এর আগে বেশিরভাগ পাতকুয়া কার্যকারিতা হারিয়েছে। প্রকল্পে উল্লেখিত ২৪২ হেক্টর জমির সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের ফলে ১৪৫৭ হেক্টর জমি আবাদি করার কথা কাগজকলমে থাকলেও তা হচ্ছে না। এসব জমি থেকে আট হাজার ১৩ মেট্রিক টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে এর দেখা মেলেনি।

নির্মাণের এক বছর পার হতে না হতে পাতকুয়ার কোনো কোনোটি অকেজো হয়ে পড়েছে। আবার এরই মধ্যে কয়েকবার মেরামত করা হয়েছে কয়েকটি। কৃষকের খরচে মেরামত হওয়ার কথা থাকলেও মেরামতের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়া হয়নি। পাতকুয়ার সমস্যা দেখা দিলে ‘তারাই’ সারিয়ে দিয়ে যান বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। এক বছরের গ্যারান্টি থাকা যন্ত্রপাতি ছয় মাসের আগেই কি করে নষ্ট হয়? প্রশ্ন তাদের। ফলে প্রকল্পের দুর্বলতা ঢাকতে কর্তৃপক্ষ সারিয়ে দিয়ে যান বলে ধারণা করছেন তারা।

চর মাজারদিয়া পূর্বপাড়া এলাকার কৃষক ইসমাইল হক বলেন, ‘থালাবাসন ধোয়া, গোসল করার জন্য ভালো, তবে চাষাবাদের জন্য না।’

পবা উপজেলার চর মাজারদিয়া পশ্চিমপাড়া এলাকায় নির্মিত একটি পাতকুয়ার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন আলম শেখ। তিনি বলেন, ‘এত টাকার জিনিসে মাত্র পাঁচ বিঘা জমিতে আবাদ হবে, এটা যুক্তিযুক্ত না। আমার নিজের জমিতেই সেচ দিতে পারি না।’

একই এলাকার আবুল কালাম আরেকটি পাতকুয়া পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। তার সাত বিঘা জমির এক কোনে বসেছে পাতকুয়া। জানতে চাইলে কালাম বলেন, ‘২০ বিঘা জমিতে সেচ দেয়া যায়। পেয়ারা, মাল্টা, সবজিতে সেচ দিই। কোনো সমস্যা নাই।’

আবুল কালামের বক্তব্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন একাধিক কৃষক। তারা বলেন, এ পাতকুয়া দিয়ে চার বিঘা জমিতে ভালোভাবে সেচ দেয়া যাবে। রোদ যতক্ষণ, পানি ততক্ষণ; রোদ শেষ, পানি শেষ। সরকার ব্যর্থ কাজ করেছে এটা। এই টাকা দিয়ে একটা ডিপ করা যেত। এখন যে অল্প জমিতে সেচ দেয়া যাচ্ছে সেটা বেড়ে ২০০ বিঘা জমিতে সেচ দেয়া যেত।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সেচ প্রকল্পের সৌর বিদ্যুৎচালিত ‘এলএসপি পাম্প’ স্থাপন হয় উপজেলা হরিপুর ইউনিয়নের মাজারদিয়ার চর এলাকায়। এই এলএসপি পাম্পের দেখাশোনা করেন স্থানীয় প্রভাবশালী মেম্বারের ভাই মাবুদ। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বেশ কয়েকটি অভিযোগ। কৃষকরা জানান, নদী থেকে পানি তুললেও তারা নিয়মিত পানি পান না। জমিতে সেচ দিতে ২০০ টাকা ঘণ্টা গুনতে হয় তাদের। আবার টাকা দিয়ে সেচ দেয়ার পরও ধান উঠলে প্রতি বিঘায় দুই মণ ধান দাবি করেছেন তিনি। তাছাড়া কৃষকদের পানি নেয়ার কার্ড করে দিতে এক হাজার টাকা দাবি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কথা হয় মাবুদের সঙ্গে। অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমার পাইটের (পারিশ্রমিক) দাম আছে। ডিপের (পাম্প) কার্ডে টাকা তোলার জন্য সারাদিন লস করে শহরে যেতে হয়। নদী পার হলেই ৪০০ টাকা খরচ হয়। তারপরেও টাকা বাকি রাখে। আমি ২০০ টাকা ঘণ্টা নিই, অস্বীকার করব না।’

প্রকল্প পরিচালক বিএমডিএর প্রকৌশলী মো. নাজিরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহীর চার উপজেলায় ২০টি ডাগওয়েল হয়েছে। পবায় ১১টা, পুঠিয়ায় ২টা, বাঘায় ২টা ও চারঘাটে ৫টা। প্রতিটি ডাগওয়েল সাড়ে পাঁচ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে পারবে এটা আমাদের টার্গেট। পাতকুয়াগুলো তার চেয়ে বেশি দিচ্ছে, সাত থেকে আট বিঘা পর্যন্ত।’

পাতকুয়ার কার্যকারিতা ও পরিচালনা কমিটি গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুললে অস্বীকার করেন তিনি। বলেন, ‘এটা আমার বিশ্বাস হয় না। আমার কাছে রিপোর্ট আছে। আট থেকে ৯ জনের একটি করে পরিচালনা কমিটি আছে। রিপোর্টে সব আছে। রিপোর্ট তো আর এমনি দেয় না!  মিনিস্ট্রির লোকজন সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন। প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে চলে। রোদ কম হলে সেদিন কম হবে। তাছাড়া ভালোই চলছে সব।’

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কেজেএম আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। ডাগওয়েল সম্পর্কে এ মুহূর্তে তথ্য নেই। তথ্য সংগ্রহ করে কথা বলতে হবে।