সোহেল রানা: কাতারে রাতারাতি কিছু পরিবর্তন এসেছে, সবই হয়েছে এক বছরে। আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার অস্ত্র প্রতিযোগিতা বহুগুণে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি রাশিয়াও এখন দেশটিতে অস্ত্র সরবরাহের পথ বাতলে দিয়েছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত জোটের অবরোধ আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এক বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে কাতারি রাজপরিবার, একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম এস-৪০০ কেনার। এর বাইরে তুরস্কের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ উচ্চতায়। সেনাঘাঁটির পাশাপাশি নৌ ও বিমানঘাঁটি গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তুরস্ককে; পাশাপাশি কাতার ভূখণ্ডে বেড়েছে তুর্কি সেনাসংখ্যাও।
তবে এক বছরে কাতারে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটা এসেছে, তা হলোÑখাদ্যোৎপাদন শিল্পে সাফল্য অর্জন। কাতার খাদ্য উৎপাদনে আগে খুব একটা নজর দিত না; এ শিল্প ছিল আমদানিনির্ভর। যা-ই হোক, প্রতিবেশী আরব ভাইদের অবরোধ কাতারকে এ শিক্ষা দিয়েছে যে, তাদের খাদ্য উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। এ ভাবনা থেকেই কাতার এখন খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছে। এক বছরে দেশটির উত্তরাঞ্চলে বেশ কিছু ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠেছে। এছাড়া একসময়কার সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাতারের ভোগ্যপণ্যের বাজার এখন ভারত, তুরস্ক, ইরান, ওমান, এমনকি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মিত্র দেশ মরক্কোর পণ্যে সয়লাব। এর বাইরে সৌদি আরব-আমিরাত, মিসর-বাহরাইনকে পাশ কাটিয়ে আলাদা বাণিজ্যিক রুট ও বিমান চলাচল রুট ঠিক করে ফেলেছে কাতার এয়ারওয়েজ। যদিও দৃশ্যমান সমস্যাগুলোর মধ্যে কাতারের সরকারি এই বিমান সংস্থাই সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে; তাদের মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত ২০টি বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামার সুযোগ হাতছাড়া করতে হয়েছে।
কুয়েত বহু চেষ্টা করেও কাতার সংকট সমাধানে সৌদি আরব-আমিরাত শাসকদের মন গলাতে পারেনি, ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন কূটনীতিও। তবে এ সংকট অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলেরই লাভ বেশি! কারণ মার্কিন অস্ত্রের বাজার স্ফীত হচ্ছে আর আরব শাসকদের অনৈক্যের সুযোগে ফিলিস্তিন ইস্যু গুরুত্ব হারাচ্ছে। এদিকে সংকট শুরুর পর উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা জিসিসি’র বাইরে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত আলাদা বাণিজ্যিক ও সামরিক জোট করেছে। এ নিয়ে বুধবার দু’দেশের দুই যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান জেদ্দায় প্রথমবারের মতো বৈঠক করেছেন। গত ডিসেম্বরে এ জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জেরুজালেম নিয়ে সৌদি আরব-আমিরাতের ভূমিকা মুসলিম বিশ্বের নিন্দা কুড়িয়েছে; বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি অব্যাহত আর্থিক সহায়তা কাতারের আমির তামিমকে দেশটিতে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে।
কাতারে অবরোধ আরোপের দুই নায়ক সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। প্রকৃতপক্ষে তারাই দেশ দুটির শাসক। এ দুই নেতার বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে ইসরাইল কানেকশনের।
গত বছরের ৫ জুন নতুন সৌদি যুবরাজের অভিষেকের আগেই কাতারকে অবরুদ্ধ করে তার আরব প্রতিবেশীরা। কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পাশাপাশি জল, স্থল, এমনকি আকাশপথেও অবরোধ আরোপ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। কাতার এয়ারওয়েজকে এসব দেশের আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, এসব দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয় কাতারি নাগরিকদেরও। অবরোধের মাত্রাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, কাতারের যেসব উট সৌদি আরবের চারণভূমিতে ঘাস খেয়ে বড় হতো, সেগুলোকেও বের করে দেওয়া হয়। সীমান্ত সিল করে দেওয়ায় খাদ্যাভাবে মারা যায় শত শত উট। এর বাইরে আর্থিক ক্ষতি তো আছেই। বিশেষ করে কাতার এয়ারওয়েজ বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছে, বাণিজ্যিক রুট ছোট হয়ে এসেছে।
তবে অবরোধকারী আরবরা যা ভেবেছিল, তার কিছুই হয়নি; উল্টো কাতারে সৌদি আরবের খাদ্যপণ্যের যে বাজার ছিলÑতা এখন তুরস্ক, ইরান, ভারত আর জার্মানির কব্জায়। কাতারে খাদ্যদ্রব্য আমদানির বড় বাজার ছিল সৌদি আরব। সেখান থেকেই কাতারের মোট খাদ্যপণ্যের ৪০ শতাংশ আসত। অবরোধের পরই একঘরে হয়ে পড়া কাতারের প্রয়োজন ছিল খাবার, আর সে সুযোগটিই লুফে নেয় ইরান ও তুরস্ক।
অবরোধ আরোপের ফলে কাতার ও ইরানের মধ্যে কেবলই যে বাণিজ্য বেড়েছে তা নয়, বরং দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কও এখন আগের চেয়ে ভালো। সৌদি আরবের জলসীমাকে এড়িয়ে সমুদ্রে নতুন নৌ চলাচলের রুট তৈরি করে ফেলেছে কাতার।
তবে অবরোধের শুরুর দিকে সাময়িকভাবে ব্যাপক সংকটের মুখে পড়ে দোহা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে কাতারের রাজপরিবার। কিন্তু তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার তাৎক্ষণিক বন্ধুত্বের হাত সম্ভাব্য সব বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে কাতারকে। মাস দেড়েক পরই দেখা গেল সেই অবরোধকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে কাতার। এক বছর পেরোল অবরোধের; কিন্তু সামান্য কোনো আর্থিক ক্ষতি ছাড়া কিছুতেই কাবু করা যায়নি কাতারকে। অবরোধের পর বরং কাতারে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। কারণ অবরোধের পর বিদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য বহু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। চলতি জানুয়ারিতে কাতার ঘোষণা দেয়Ñদেশটিতে এখন থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন ব্যবসায় শতভাগ মালিকানা পাবেন। এর আগে কাতারে কেবল ৪৯ শতাংশ মালিকানা নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ ছিল বিদেশিদের।
অবরোধ আরোপের পর প্রতিবেশীদের সম্ভাব্য আক্রমণের শঙ্কায় কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি সরাসরি সহায়তা চান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাছে। মিসর, সিরিয়া, লিবিয়াসহ আরব দুনিয়ায় রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে কোণঠাসা হয়ে পড়া মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে তুরস্ক এখন অতিপরিচিত নাম। ব্রাদারহুডের সঙ্গে কানেকশনের অভিযোগ আছে কাতারের বিরুদ্ধেও। ব্রাদারহুড ও ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসেরও কট্টর সমর্থক এ দুই দেশ। তাই আদর্শগত মিত্রকে রক্ষায় দেরি করতে চাইলেন না এরদোগান। খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি কাতারে থাকা তুর্কি সামরিক ঘাঁটিতে ঘোষণা দিলেন সেনাসংখ্যা বাড়ানোর।
মূলত এ অবরোধে সৌদি আরব-আমিরাতের শত্রুরাই শক্তিশালী হলো। তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে কাতারের ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। অবরোধ আরোপের পর রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে কাতার। দেশটিকে এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম দিতে রাজি হয়েছেন পুতিন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক ঝালাই করে নিয়েছেন কাতারের আমির। সংকটের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১১ বিলিয়ন ডলারের সামরিক অস্ত্র কেনার চুক্তি করে কাতার। কাতার ও সৌদি আরব উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটিটিই কাতারে; সেখানে রয়েছে ১১ হাজারের মতো মার্কিন সেনা। কাতারের বিরুদ্ধে আরব ভাইদের অবরোধ মূলত সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের বাজারটা স্ফীত করল। আরবদের ঐক্য ভাঙনে খুশি ইসরাইলও।
জিসিসি থেকে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল অবরোধকারী চার দেশ। যে অভিযোগে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করা হলো, তা যে অসার ও মিথ্যাÑতা ধরা পড়ে খোদ মার্কিন গোয়েন্দারের কাছে। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে বলা হয়, গত বছরের মে মাসের শেষদিকে কাতারের সরকারি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হ্যাক করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছিল যে, কাতারের আমির ইরানকে ‘ইসলামি শক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের প্রশংসা করেছেন। অথচ এটি ছিল পুরো ভুয়া ও বানোয়াট গল্প।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, কাতারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিরোধের জেরেই সংকটের শুরু। কাতার আঞ্চলিক বিরোধ ও রাজনীতিতে যেভাবে ভূমিকা রাখছিল, তা প্রতিবেশী আরবদের মনঃপূত হচ্ছিল না। বিশেষ করে সিরিয়া ও লিবিয়া ইস্যুতে কাতারের ভূমিকা ভালো চোখে দেখেনি সৌদি আরব-আমিরাত গোষ্ঠী। আঞ্চলিক রাজনীতি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে একটি নিরপেক্ষ মঞ্চ হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিল কাতার। ফলে ধীরে ধীরে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল দোহা। ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কাতারের এমন ভূমিকাই ঈর্ষান্বিত করেছে প্রতিবেশীদের।
এছাড়া কাতারি গণমাধ্যম আলজাজিরার সঙ্গে রয়েছে সৌদি আরব-আমিরাত-মিসরের পুরোনো দ্বন্দ্ব। ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকজন স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। মিসরে হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন, তিউনিসিয়ার বেন আলীও পালিয়ে সৌদি আরব চলে যান। গণঅভ্যুত্থান ঘটে লিবিয়া, সিরিয়া, এমনকি বাহরাইন ও সৌদি আরবের শিয়া অধ্যুষিত এলাকা কাতিফে। সেই আরব বসন্তের সবচেয়ে ভালো কাভারেজ দিয়েছিল আলজাজিরা। সে থেকেই কাতারি এই গণমাধ্যমকে সন্দেহের চোখে দেখে সৌদি আরব ও তার আরব মিত্ররা। তাই অবরোধ প্রত্যাহারে কাতারকে যে ডজনখানেক শর্ত পালনের প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেওয়া হয়, তাতে আলজাজিরা বন্ধের দাবিও ছিল। কিন্তু অবরোধে কাতারকে খাদে ফেলে দেওয়া যায়নি। সৌদি আরব ও আমিরাতেরও কোনো অর্জন নেই; উল্টো তাদের শত্রু রাষ্ট্র ইরান কাতারে বাণিজ্য ও কূটনীতি জোরদারের সুযোগ পেল। তুরস্কও এ সুযোগে সেনা উপস্থিতি বাড়াল দোহায়। অস্ত্র বিক্রি করল যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া।
গণমাধ্যমকর্মী
sohel.shalban@gmail.com
