পলাশ শরিফ: চলতি বছরের মাঝামাঝিতে সিস্টেম আপডেট করেছে বহুজাতিক সেলফোন অপারেটর বাংলালিংক। গ্রাহকসংখ্যায় তৃতীয় অবস্থানে থাকা কোম্পানিটি তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক সেবার পরিধি বাড়াতেই এমন উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সিস্টেম আপগ্রেডের পর কারিগরি ত্রুটির কারণে গ্রাহকদের ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।
নতুন সিম কেনা বা প্রতিস্থাপনে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ও বিভিন্ন হটলাইন শর্টলিংকে কল করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বাংলালিংক গ্রাহকরা। আপগ্রেডেশনের কাজ শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ‘কারিগরি জটিলতা’ কাটিয়ে ওঠার কথা বলা হলেও ১৫ দিনেও সংকট কাটেনি।
বেসরকারি ব্যাংকের জনৈক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী গত ২২ ডিসেম্বর বিকাশ নম্বর থেকে ভিসা কার্ডের বিল পরিশোধ করেন। বিল পরিশোধের পরও বিকাশ বা ব্যাংক থেকে নিশ্চিতকরণ এসএমএস আসেনি। বিষয়টি জানতে তিনি বিকাশ-এর হটলাইনের শর্টলিংক নম্বরে (১৬২৪৭) ফোন করেন। কিন্তু অপারেটরের তরফ থেকে জানানো হচ্ছে, ‘আপনার অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স নেই।’ এরপর ব্যালেন্স চেক করে তিনি তার অ্যাকাউন্টে ১০০ টাকার বেশি ব্যালেন্স দেখতে পান। এরপর ব্যাংকের হটলাইন থেকে আপডেট জানতে ব্যাংকের পাঁচ ডিজিটের শর্টলিংক নম্বরে ফোন করেন। আবারও ‘আপনার অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স নেই’ বলে শুনতে পান। বাধ্য হয়ে তিনি বাংলালিংকের কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসের (১২১) নম্বরে যোগাযোগ করলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিষয়টির সুরাহা হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু ১০ দিনেও ভোগান্তি কাটেনি।
গ্রাহক পরিচয়ে কাস্টমার কেয়ারে যোগাযোগ করা হলে বলা হয়, ‘গ্রাহকসেবার মান বাড়াতেই কারিগরি উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে। এর পর থেকে কিছু ত্রুটি এখনও রয়ে গেছে। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।’ এ কথা জানানো হলেও কারিগরি ত্রুটির বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলালিংকের দায়িত্বশীলরা মুখ খুলছেন না।
বহুজাতিক কোম্পানিটির সিনিয়র করপোরেট কমিউনিকেশন ম্যানেজার অংকিত সুরেকাও ‘আমি ছুটিতে আছি, অফিসে ফিরলে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানাতে পারব’ বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা দেওয়ার জন্য গত ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে কারিগরি উন্নয়নে কাজ করেছে বাংলালিংক। পূর্বঘোষণা ছাড়াই কারিগরি উন্নয়নের কাজ শুরুর কারণে ওই দুই দিন বিপত্তির মুখে পড়েন গ্রাহকরা। ইন্টারনেট-মিনিট ব্যালেন্স, প্যাকেজ কেনা, রিচার্জ, সিম তোলা, কল রেট, অফার ও প্রতিস্থাপনে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপ প্রদানসহ বিভিন্ন সেবা নিতে ভোগান্তির মুখে পড়েন গ্রাহকরা।
গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ভোগান্তির জন্য বাংলালিংকের ফেসবুক পেজে এক বার্তায় দুঃখ প্রকাশ করা হয়Ñ‘গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর বাংলালিংকে কারিগরি উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ কারণে কিছু সেবা পেতে আপনাদের সাময়িকভাবে সমস্যা হয়ে থাকলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমাদের সকল সেবা পুনরায় চালু হয়েছে।’ কিন্তু ওই বার্তায় প্রত্যুত্তরে ভোগান্তির তথ্য দিয়ে সমাধান চান হাজার হাজার গ্রাহক। এর মধ্যে কেউ কেউ সমালোচনা ও গালাগাল করেন। এর বিপরীতে দুঃখ প্রকাশ করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই সমস্যা সামাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়।
কারিগরি উন্নয়নের ঘোষণার পরদিন (১৫ ডিসেম্বর) দুপুরে ফেসবুক ব্যবহারকারী ইলিয়াস আহমেদ লেখেন, ‘আমার সিমে ছিল ৪৪ টাকা। সেটা গায়েব। ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনব বলে ১৪০ টাকা রিচার্জ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে দুই টাকা গায়েব। আজ সকালে ইন্টারনেট কিনতে গিয়ে দেখি ১১৫ টাকা, অর্থাৎ আবারও ২৩ টাকা গায়েব। আর হ্যাঁ, এই সিম থেকে এক সেকেন্ডও কথা বলা হয়নি। এক্ষেত্রে কী করতে পারি আমি?’ এর পর থেকে এখনও ওই পোস্টের নিচে অভিযোগ করছেন কারিগরি উন্নয়নের কারণে বিপাকে পড়া গ্রাহকরা, যার অধিকাংশই ছিল অতিরিক্ত ব্যালেন্স কেটে নেওয়া, নেট বা প্যাজেজ চালু করতে না পারা, ব্যালেন্স কমে যাওয়া, কল করতে না পারা, রিচার্জ করতে না পারা ও ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স না পাওয়া সংক্রান্ত।
এদিকে এসব অভিযোগের জবাবে সব সময়েই প্রায় একই ধরনের উত্তর দেওয়া হয়েছে এবং কাস্টমার কেয়ারে অভিযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কখনও কখনও ‘কনসার্ন ডিপার্টমেন্ট এ বিষয়ে কাজ করছে’ উল্লেখ করে, কখনও ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ বা কখনও ‘খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে’ বলেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ১০ দিনেও সেই সময় শেষ হয়নি। এখনও কারিগরি উন্নয়নের সুফলের বদলে ভোগান্তির শিকার গ্রাহকরা।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে গ্লোবাল টেলিকম হোল্ডিং এসএই (পূর্ববর্তী ওরাসকম টেলিকম হোল্ডিং) বাংলাদেশের তৎকালীন সেবা টেলিকম প্রাইভেট লিমিটেডের শতভাগ শেয়ার কিনে নেয়। এরপর ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলালিংক নামে যাত্রা করে কোম্পানিটি। ওরাসকমের কাছ থেকে পরে বাংলালিংকের সিংহভাগ মালিকানা চলে যায় বহুজাতিক সেলফোন অপারেটর কোম্পানি ভিওনের হাতে। ২০০৭ সালে সেলফোনের বাজারে দ্বিতীয় অবস্থান দখল করে বাংলালিংক। রবি-এয়ারটেল একীভূতকরণ ও বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম পুনর্নিবন্ধনের কারণে এক ধাপ পিছিয়ে এখন তৃতীয় অবস্থানে কোম্পানিটি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বাংলালিংকের গ্রাহকসংখ্যা সাড়ে তিন কোটিতে দাঁড়িয়েছে।