কার্টুনই আমাকে রক্ষা করল

আলি দোরানি। একজন কার্টুনিস্ট। ২১ বছর বয়সে ইরান থেকে পালিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিতর্কিত মানুস দ্বীপে হন কারাবন্দি। সেখানকার কয়েদখানায় পরবর্তী চার বছর কাটে তার। কিন্তু তার কার্টুনগুলো যখন অনলাইনে প্রকাশ পেল, তখনই সবকিছু পাল্টে গেল। সেসব দিনের কাহিনি-চিত্র তার নিজের ভাষায় বিবিসিতে প্রকাশ পায়

২০১৩ সাল। আমি ইরান ত্যাগ করি। কিন্তু কেন? তা আমি বলতে পারব না; কেবল আমার পরিবারের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে। অন্তত এটা বলা চলে যে, আমার জীবন ছিল বিপদের মধ্যে। ৪০ দিন আমি কাটালাম ইন্দোনেশিয়ায়। তারপর অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমানোর চেষ্টা। আমি জানতাম, অস্ট্রেলিয়াই হলো আমার নিরাপত্তার জন্য নিরাপদ গন্তব্য। এক মানব পাচারকারী আমাকে কথা দিল, সে আমাকে নৌকাযোগে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে দেবে।
আমি যখন নৌকায়, তখন আমার অন্তরাত্মা ভয়ে কুচকে এসেছিল আমি বুঝি মারা যাব! এটা ছিল মাত্র একটি মাছ ধরা নৌকা। হাল-হকিকতও ভালো ছিল না। দক্ষ হাতে যে এটা চালানো হচ্ছিল, তাও বলা যাবে না। আমরা ছিলাম মোট ১৫০ জন। আর আমি তো সাঁতারই জানি না!
যখন নৌকায় চড়ার সময় হলো, আমি নিজেকেই বলছিলাম: ‘এটাই বাস্তব। যদি কোনো কিছু ঘটে যায় এই দুর্বল নৌকায় আমি মরে যাব।’ ৫২ ঘণ্টার ভ্রমণ। বর্ষণ চলছিল। সমুদ্রের মেজাজ ছিল না স্বাভাবিক। সবকিছুই ছিল ভীতিকর।
অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনী আমাদের আটক করল। তারপর নিয়ে গেল ক্রিসমাস দ্বীপে। সেখানে ছিল একটি কয়েদখানা। নৌকাযোগে যেসব আশ্রয়প্রার্থী অস্ট্রেলিয়া আসে, এখানেই তাদের রাখা হয়। আমার শরীর ভালো ছিল না। আমি ওসিডি’তে (অবসেসিভ কাম্পালসিভ ডিসঅর্ডার) ভুগছিলাম। রোগটি আমাকে বেশ কয়েক বছর ধরে ভোগাচ্ছিল। কিন্তু এই ক্রিসমাস দ্বীপে আসার পর আরও বেশি মারাত্মক রূপ ধারণ করল।
আমি আশেপাশের চৌহদ্দি-পরিবেশ খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতাম সব সময়। কিন্তু এ একটি ঘরে আমাকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে থাকতে হচ্ছিল। তাই কোনোভাবেই পুরো পরিবেশটি নিজের মতো করে রাখতে পারছিলাম না। এ সময় আমার আদৌ কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
এমন সময়ও এসেছে, পড়ার জন্য আমার ডিকশনারিটিকেও পানিতে ধুয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কেননা, আমার কাছে মনে হতো এই ডিকশনারিতেও যেন ময়লা, ধুলাবালি লেগে আছে। আমি বারবারই নিজেকে বলে চলেছি: আমি পাগল হতে চলেছি। আমার ভেতরে আসলে ঝাকুনি দিতে থাকে আর আমি স্নায়ু চাপে মুষড়ে পড়ি। সেখানকার ডাক্তারখানায় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। ডাক্তার আমাকে ওষুধ খেতে বলেন। অথবা পরামর্শ দেন, আমি যেন আমার ওসিডি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কিছু কৌশল মেনে চলি।
আমি আসলে কোনো ওষুধ খেতে চাচ্ছিলাম না। কেননা, ওষুধ খেলে হয়তো অস্ট্রেলিয়া সরকার আমাকে পাগল বলে সাব্যস্ত করবে এবং তার দেশে প্রবেশের অযোগ্য বিবেচনা করে আমাকে তাদের কালোতালিকায় ফেলে দেবে। এক সময় আমি আমার ঘরে ফিরে এলাম। ধীরে ধীরে স্মরণ করতে থাকলাম: আরে! আমার তো একটি মেধা আছে। আমি তো আঁকতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি আঁকতে শুরু করি। আঁকতে থাকি আমার ওসিডি নিয়ন্ত্রণের একটি ভালো কৌশল হিসেবে।
আমার এ ছবি আঁকা সেই ছোটবেলা থেকেই। তখন আমার বয়স পাঁচ। আমার যত প্রাচীন স্মৃতি রয়েছে, তার মধ্যে সেই ছোটবেলার ছবি আঁকার স্মৃতি: অতি শৈশবের অতি প্রাচীন স্মৃতি। ইরান পালিয়ে আসার কয়েক বছর আগে আমি ছবি আঁকা ছেড়েছিলাম। আমি তখন আমার কাজ ও জীবন নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি; কিন্তু এতদিন বাদে এ পরিবেশে নতুন করে সেই ছবি আঁকা আমার জন্য খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। নতুন করে ছবি আঁকতে গিয়ে আমি খুব দুর্বল বোধ করছিলাম।
সব সময় ছবি আঁকার মতো কিছু থাকেও না। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের আমরা সব সময়ই ছবি আঁকার উপকরণ চেয়ে অনুরোধ জানাতাম। কিন্তু তারা আমাদের সব সময় কাগজ ও পেনসিল সরবরাহ করতেন না। তাই আমি কাগজ চুরি করতে বাধ্য হতাম। আমাকে ভাষা শিক্ষার ক্লাসে যেতে হতো। সেখান থেকেই আমি কাগজ চুরি করতাম। শিক্ষক যখন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতেন, তখন আমি কাগজগুলো লুকিয়ে নিতাম।
আমার যেহেতু পর্যাপ্ত কাগজ থাকত না, সে কারণে আমাকে খুব সতর্কতার সঙ্গে আঁকতে হতো। আমি কোনো ভুল করতেই পারতাম না। ফলে আমার আঁকার দক্ষতাও বাড়তে থাকে। কার্যত ছবি আঁকা আমার ওসিডি রোগকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। আমি যতই ছবি আঁকি, আমার ওসিডির মাত্রা দিনে দিনে আরও বাড়তে থাকে।
যাহোক, আমি যা-ই আকতাম, তা অন্য কয়েদিদের দেখাতাম। আবার কিছু কিছু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকেও দেখাতাম। ফলে সবাই আমার কার্টুন দেখে মুগ্ধ হতে থাকে। আমার কার্টুনের প্রতি তাদের একটি টান তৈরি হতে থাকে। আমি সেখানে আমার নিজের জীবনই ফুটিয়ে তুলতাম। যখন আমি খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম, তখন যা যা ঘটত, তা এঁকে ফেলতাম। আবার নোংরা পায়খানা ব্যবহারের সময় যা ঘটে যেত, তাও আমি আমার ছবিতে ফুটিয়ে তুলতাম।
প্রথমবারের কথা আমার মনে পড়ে। প্রথমবারই যখন লোকে আমার ছবি দেখল, তখনই তারা তা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। একটি টি-শার্টের ওপর আমি অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ আঁকি। ম্যাপটির মাঝে ছিল দুটি চোখ। চোখ দুটি কাঁদছিল অবিরত ধারায়। আর ছবিটির নিচে কেবল এ কথাই লেখা ছিল: ‘আই এম অনলি এ রিফিউজি (আমি কেবলই একজন উদ্বাস্তু)।’
দুজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তারা জিজ্ঞেস করলেন, কেন আমি আমার টি-শার্টে এটা এঁকেছি। তাদের চোখে মনে হয়েছিল, আমি যেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা আপত্তির জায়গা থেকে এটা করেছি। আসলে এখানে আমি কোনো প্রতিবাদ বা আপত্তিজাতীয় অর্থ করিনি। এমনকি আমার ছবি যে এত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে, তাও কখনও ধারণা করতে পারিনি। পরিশেষে আমাকে এটাই বুঝতে হলোÑআমার ছবি অন্যকে আঘাত করতে বা প্রভাবিত করতে সক্ষম।
তাই আমি কার্টুন আঁকা চালিয়ে গেলাম। কয়েদখানায় আমার নিত্যদিন নিয়ে নিয়মিত ডায়রিতে আঁকতে থাকলাম। আর নিয়ত আমার সেসব ছবিতে ইতিবাচক ও নেতিবাচত মন্তব্য পেতে থাকলাম। তবে আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম, হয়তো আমার ছবি আশ্রয়-আবেদনের ওপর প্রভাব ফেলবে। আবার এটাও ভাবতাম, এই কয়েদখানায় থাকার চেয়ে কষ্টের কিছু নেই। আমি খুব হতাশায় দিন-রাত পার করছিলাম। আর আমার ওসিডি কঠিন থেকে কঠিন রূপ ধারণ করতে থাকে। তাই আমি এটাও ভাবতাম, আমি হয়তো কোনো দুঃস্বপ্নের ঘোরে পড়ে আছি; আমার আসলে এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
এমনকি পরবর্তীকালে যেখানে আমি থাকতে শুরু করি, তার চেয়ে ক্রিসমাস দ্বীপ ছিল অনেক বেশি সুন্দর। ছয় মাস পর আমাকে মানুস দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এটা ছিল ২০১৪ সালের জানুয়ারি। তারা আমাদের হাতকড়া পরিয়ে দিল। আর পাঁচ নিরাপত্তাকর্মী আমাকে ঘিরে রাখল। কোনো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে এটিই ছিল আমার প্রথম সফর। খুব গরম ছিল তখন। শ্বাস নেওয়াটাই ছিল কষ্টকর। দেখতে এটা ক্রিসমাস দ্বীপের কয়েদখানার মতো ছিল না। দেখে মনে হতো, এখানে হয়তো কেবল মুরগি, শূকর বা ভেড়া পোষা যায়।
আমাদের অনেকগুলো তাঁবু ছিল। ঘরগুলো ছিল ময়লায় আচ্ছন্ন। পায়খানা ছিল নোংরা। গোসলের ঝরনা ছিল ভয়ানক। শত শত লোক এই ছোট্ট কয়েদখানায় গাদাগাদি করে থাকত। কিছু কিছু প্রহরী আমাকে বারবার নিশ্চিত করে বলেছিল, তারা আমার চোখে-মুখে কেবলই আহত প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। তারা বলল: ‘চিন্তা করো না, সবকিছুই ভালোর দিকে যাচ্ছে।’
তখন আমার মাথায় ঘুরতে লাগল, আমার পছন্দ বলে কিছু থাকবে না। নিজের মতো করে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন আমার শেষ হয়ে এসেছে। আমি চাইলেও পারব না দেশে ফিরে যেতে। আবার অস্ট্রেলিয়াতেও থাকতে পারব না। কিন্তু নিজেকে হত্যা করতেও চাইতে পারব না। আমি কেবল আমাকে একটি মরদেহের মতোই ভাবতে লাগলাম, যে মরদেহ কেবল নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। (চলবে)

বিবিসি নিউজ থেকে
ভাষান্তর: মিজানুর রহমান শেলী