‘কালোটাকা’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ‘ধূম্রজাল সৃষ্টির কৌশলে’: মির্জা ফখরুল

নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘কালোটাকা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া অপ্রদর্শিত আয় সাদা বা বৈধ করার সুযোগ দেয়াকে ‘বড়শিতে আধার গেঁথে মাছ শিকারের’ সঙ্গে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে ‘ধূম্রজাল সৃষ্টির কৌশল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

রাজধানীতে গতকাল শনিবার এক আলোচনায় তিনি আগের দিন সরকারপ্রধানের দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানান।

বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জেএসডি আয়োজিত ‘বাঙালির জাগরণে করণীয় ও সিরাজুল আলম খান’ শীর্ষক এই আলোচনায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এটা (বড়শিতে আধার গেঁথে মাছ শিকার) হাস্যকর কথা। আমরা তো দেখলাম যে, আপনারা ওই মাছের টোপ দিয়ে যাদের ধরেন, তারা নিজেরাই তো এর সঙ্গে (দুর্নীতি) জড়িত।

‘আপনি বাজেট দেখলেই বুঝতে পারবেন, ‘রাঘব বোয়ালদের’ খাবারের আরেক ব্যবস্থা করেছে। প্রত্যেক বছর একই ঘটনা ঘটছে এবং এর মধ্যে যারা অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, তারা বলছেন, এটা (অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করা) শুধু ক্ষতি ছাড়া আর কিছু করবে না।

‘যেখানে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্যে ইনফ্লেশন… দ্রব্যমূল্য এত বেশি বেড়ে গেছে যে, এটা সাধারণ মানুষের কাছে সহনীয় হচ্ছে না। আজকে এই সমস্যার কথাগুলো বলে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি করে মানুষকে কত দিন প্রতারিত করে রাখা হবে।’

‘আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), সুশাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-সহ (টিআইবি) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদরা এর সমালোচনা করছেন। বলছেন, ‘এমন বিধান নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না।’

শুক্রবার ঢাকায় ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালোটাকা’ হিসেবে অপ্রদর্শিত আয় সাদা বা বৈধ করার সুযোগ দেয়াকে ‘বড়শিতে আধার গেঁথে মাছ শিকারের’ সঙ্গে  তুলনা করেন।

তিনি বলেন, ‘আমি বলি, মাছ ধরতে গেলে তো আধার দিতে হয়, দিতে হয় না? আধার ছাড়া তো মাছ আসবে না। সেই রকম একটা ব্যবস্থা, এটা আসলে আগেও হয়েছে। সেই তত্ত্বাবধায়ক আমলেই শুরু করেছিল, আর পরেও প্রত্যেক সরকারই করে। সেই সুযোগটা আমরাও দিয়েছি। অল্প ট্যাক্স দিয়ে সেই টাকাটা তোমরা ব্যাংকে নিয়ে এসো, সেই ব্যবস্থাটাই হয়েছে।

‘জিনিসের দাম বেড়েছে। এখন এক কাঠা জমি যার, সেই কোটিপতি। কিন্তু সরকারি যে হিসাব, সেই হিসাবে কেউ বেচে না, বেশি দামে বেচে বা কিছু টাকা উদ্বৃত্ত হয়। এই টাকাটা তারা গুঁজে রাখে। গুঁজে যাতে না রাখে, সামান্য একটা কিছু দিয়ে যাতে সেই টাকাটা আসল পথে আসুক, জায়গা মতো আসুক। তার পরে তো ট্যাক্স দিতেই হবে।’

সিরাজুল আলম খানের জন্য শোকবার্তা না দেয়ার কারণেও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন ফখরুল।

২০২৩ সালের আজকের দিনে মারা যাওয়া সিরাজুল ছাত্রজীবনে জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ষাটের দশকে ছাত্রলীগে যে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন হয়েছিল, তাতেও ছিলেন এই রাজনীতিক।

তবে মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

তিনি কখনও নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন।

সিরাজুল আলম খান কখনও জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।

জাসদের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুতে বিএনপি চেয়ারম্যান খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, ‘আমি মাহমুদুর রহমান মান্না সাহেবের পাশে বসে ছিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম সিরাজুল আলম সাহেবের মৃত্যুর পরে আওয়ামী লীগ থেকে কি কোনো শোকবাণী দেয়া হয়েছিল? তিনি বললেন, না দেয়া হয়নি।’

‘একবার ভাবুন, কত বড় অকৃতজ্ঞ হলে একটি দল যাদের মূল চালিকাশক্তির মধ্যে এই মানুষটি ছিলেন, তারা সহানুভূতি দিতে চায়নি। আজকে সেই একই কারণে জিয়াউর রহমানকে তারা সহ্য করতে পারে না, অনেককে পারে না। যারা এ দেশের জন্য অবদান রেখেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অবদানকে অস্বীকার করাটা সম্পূর্ণভাবে অকৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়।’

সরকার দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ‘ধ্বংস করে দিয়েছে’ বলে অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আজকে আমরা এমন একটা শাসকগোষ্ঠীর জাঁতাকলে পড়েছি, যারা মানুষের কল্যাণের জন্য কিছু করা তো দূরে থাকুক, তারা মানুষকে শোষণ করছে, নিগৃহীত করছে, নিপীড়ন করছে এবং প্রতি মুহূর্তে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে।’

দেশে গণতন্ত্র নেই বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা একমাত্র উপায়।

‘আমাদের অধিকার’কে ফিরিয়ে আনা, ‘ভোটের অধিকার’ ফিরিয়ে আনা, ‘বেঁচে থাকার অধিকার’ নিশ্চিত করা, আমাদের ‘কথা বলার’ অধিকার নিশ্চিত করাÑএ বিষয়গুলো আজকে আমাদের সবচেয়ে বেশি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং সেই আমাদের অর্জন করতে হবে।

দলমত নির্বিশেষ ‘ছোটখাটো’ দোষ-ত্রুটি ভুলে একজোট হয়ে লড়াই শুরুর আহ্বানও জানান ফখরুল।

জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের সভাপতিত্বে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারীর সঞ্চালনায় আলোচনায় নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, বাংলাদেশ জাসদের নুরুল আম্বিয়া, ভাসানী অনুসারী পরিষদের শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডির নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপ্ন, কেন্দ্রীয় নেতা তানিয়া রব, মোহাম্মদ সিরাজ মিয়া, কেএম জাবির প্রমুখও বক্তব্য দেন।