আজিজুল হক : ভারত ও পাকিস্তান- দক্ষিণ এশিয়ার দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। তবে এদের সম্পর্ক এক দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু কাশ্মীর সংকট। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভাজনের সময় থেকেই কাশ্মীর প্রশ্ন দুই দেশের মধ্যে সংঘাত ও শত্রুতার অন্যতম উৎস হিসেবে রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরপরই কাশ্মীর ইস্যুতে প্রথম যুদ্ধের সূচনা হয়, যার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ পর্যন্ত। সময়ের পরিবর্তনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমস্যা নিরসনের চেষ্টা হলেও, কাশ্মীর আজও একটি অমীমাংসিত ভূখণ্ড হিসেবেই রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিলে কাশ্মীরের পাহালগামে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা দুই দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। পর্যটকদের লক্ষ্য করে চালানো ওই সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ভারতের দাবি, পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) এই হামলার পেছনে রয়েছে। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানায়। এই ঘটনার পরপরই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক চরম উত্তেজনার পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
যার ফলশ্রুতিতে ওই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের অবস্থা বিরাজমান করছে। নিজেদের পরমাণু শক্তি জানান দেয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান গত ৩ মে আবদালি ব্যালিস্টিক মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে, যা ৪৫০ কিলোমিটার দূরের যেকোনো বস্তুতে আঘাত আনতে সক্ষম। অপরদিকে ভারতও এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নই। তারাও ফাইটার জেট বিমানের হামলার প্রস্তুতি পুরোদমে নিচ্ছে। সীমান্তে নিয়মিত গুলিবিনিময় চলছে এবং উভয় দেশের মধ্যে ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনা ঘটেছে, যা পাকিস্তানের ওপর স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আকাশ ও স্থলপথের পাশাপাশি নৌপথের একই অবস্থা দৃশ্যমান। দুই দেশের নৌবাহিনীরাও থেমে নেয়। তারাও নদী ও সমুদ্র পথে নিজেদের প্রস্তুতি এবং সামরিক মহড়া ও পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি দেখে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে যে সরাসরি যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তান জড়িয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে-
পাকিস্তান প্রথমেই কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়ে ভারতকে থামাতে চাইবে এবং ভারত তার বৃহৎ সামরিক শক্তি দিয়ে পাকিস্তানের অবকাঠামোয় আঘাত হানতে পারে। আর এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে বাহিরে চলে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন যদি এই উত্তেজনা একেবারে যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়, তবে সেই যুদ্ধ কেমন হতে পারে? কারা এগিয়ে? কতটা ক্ষতিকর হবে এই উপমহাদেশের জন্য? আর এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে প্রথমেই ভারত-পাকিস্তানের সামরিক শক্তি তুলনার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা বাজেট,পরমাণু অস্ত্র, প্রচলিত সেনাশক্তি এবং সম্ভাব্য যুদ্ধের চিত্র জানা জরুরি।
প্রথমত প্রতিরক্ষা বাজেটের তুলনা করলে দেখা যাবে যে বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ২০২৫ ভারত বরাদ্দ দিয়েছে ৭৬ বিলিয়ন ডলার যা বিশ্ব র্যাংকিংয়ে তৃতীয়। অপরদিকে এক্ষেত্রে পাকিস্তান বরাদ্দ দিয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলার এবং তাদের র্যাংকিং ২৫তম থেকে ২৮তমে অবস্থান করছে। পাকিস্তানের চেয়ে প্রতিরক্ষা বাজেট ভারতের প্রায় ৭ গুণ বেশি। তবে পাকিস্তান এই ঘাটতি পূরণ করবে তুরস্ক ও চীনের সাহায্যে। পাশাপাশি তারা কম খরচে কার্যকরী কৌশল বেছে নেবে। বিশেষ করে অসম যুদ্ধ, প্রক্সি গোষ্ঠীর ব্যবহার, ড্রোন ও সাইবার হুমকির ওপর নির্ভর করে।
এবার আসা যাক পরমাণুর অস্ত্রের দিকে। এক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে ভয়াবহতার ভারসাম্য পরিলক্ষিত। ভারতের কাছে আনুমানিক ওয়ারহেড সংখ্যা আছে ১৬০ থেকে ১৭০ এবং অগ্নিসিরিজ ও সাবমেরিন প্রমুখ নামক মিসাইল রয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তানের ওয়ারহেড সংখ্যা ১৬৫ থেকে ১৭০ এবং শাহিন সিরিজ, গৌরি সিরিজ ও এফ-সিক্সটিন ইত্যাদি নামক মিসাইল।
এছাড়া সামরিক শক্তির দিকটি বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে ভারতে সক্রিয় সেনাসদস্য রয়েছে প্রায় ১৪ দশমিক ৫ লাখ আর রিজার্ভ আছে ৯ লাখের মতো। যুদ্ধবিমান ৫৮০টির মতো ও ট্যাংক আছে ৪ হাজার ৭০০টি। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের সক্রিয় সেনাসদস্য প্রায় ৬ দশমিক ৫ লাখ আর রিজার্ভ আছে ৫ লাখের মতো। যুদ্ধবিমান ৩৭০টি ও ট্যাংক পরিমাণ আছে ২ হাজার ৬০০টি। আর নৌ-শক্তিতে পাকিস্তানের চেয়ে ভারত বেশ অনেকটা এগিয়ে আছে।
যুদ্ধের ভয়াবহতা ব্যাপারে ধারণা করা হচ্ছে দুই ধরনের সংঘর্ষ হতে পারে।
১. সীমিত সংঘর্ষ-যা ইতোমধ্যে দু-দেশের মধ্যে চলমান রয়েছে। আর এই সংষর্ষের ফলে কাশ্মীর ও পাঞ্জাব প্রান্তে নিয়মিত সীমিত পরিসরে গোলাগুলি এবং স্পেশাল বাহিনি দিয়ে দুই পক্ষই সংঘর্ষ চালাচ্ছে। তবে এমন সংঘর্ষ আন্তর্জাতিক চাপে দ্রুত থেমে যেতে পারে। তবে আকস্মিক জনমনে আতঙ্ক ও উত্তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
২. পূর্ণমাত্রার সংঘর্ষ-
পূর্ণমাত্রার সংঘর্ষ হলে আকাশ ও স্থলপথে যুদ্ধের পাশাপাশি সাইবার আক্রমণ, নৌ-অবরোধ এমনকি পরমাণুর হুমকি চলে আসবে, যা অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতির দিকে ভারত-পাকিস্তান উভয়কেই ফেলে দেবে।
আর এর ক্ষয়ক্ষতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহতা শুধু দুই দেশের জন্যই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য। সম্ভাব্য যেসব ক্ষয়ক্ষতির
আশঙ্কা করা হচ্ছে-
১. মানবিক বিপর্যয়: উভয় দেশের জনসংখ্যা বিপুল (ভারত-১৪০ কোটি আর পাকিস্তানের ২৫ কোটির মতো)। যুদ্ধে হাজার হাজার বা লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। বিশাল সংখ্যায় মানুষ আহত, গৃহহীন বা শরণার্থী হয়ে পড়তে পারে।
২. অর্থনৈতিক ধ্বংস: যুদ্ধ চলাকালীন শিল্প, ব্যবসা, কৃষি, অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উভয় দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। যার প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় পড়বে।
৩. পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা ও ঝুঁকি : উভয় দেশের কাছেই পরমাণু অস্ত্র আছে। যদি যুদ্ধ পরমাণু পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তাহলে তা হবে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, লাখ লাখ প্রাণহানি ঘটবে এবং পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে।
৪. আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব: দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো (বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, নেপাল, ইত্যাদি) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পক্ষান্তরে বিশ্ব শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে, কারণ ভারত ও পাকিস্তান দুটিই আন্তর্জাতিক মিত্রতা এবং সামরিক জোটে জড়িত। ভারতের পাশে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইজরায়েল ও জাপান। পাকিস্তানের সঙ্গে আছে চীন ও তুরস্ক।
যদিও পরিসংখ্যানগত ও সামরিক শক্তিতে আপাতদৃষ্টিতে ভারত এগিয়ে আছে। তবে যুদ্ধের ফলাফল কোনো পক্ষেরই প্রকৃত বিজয় হবে না। বরং জয় হবে কেবল মানবিক বিপর্যয় ও ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির।
যদিও উভয় দেশই যুদ্ধ এড়াতে চায়, তবে জাতীয়তাবাদী আবেগ, রাজনৈতিক চাপ, কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি এবং সামরিক প্রস্তুতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়ের উচিত দ্রুত হস্তক্ষেপ করে উভয় পক্ষকে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথে আনা, যাতে এই সংকট আরও গভীর না হয়। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা শুধু দুই দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়, এটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কাশ্মীর সমস্যার একটি ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই সমাধান না হলে এ ধরনের সংঘর্ষ বারবার ফিরে আসবে। সাম্প্র্রতিক পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যুদ্ধ নয়, সংলাপই পারে এই সংকটের স্থায়ী সমাধান আনতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়