Print Date & Time : 28 August 2025 Thursday 4:59 pm

কিশোর গ্যাং কালচার রুখে দিতে হবে

দেশব্যাপী অপরাধ জগতের ভয়ংকর আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। সারাদেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহƒত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। ‘রং মেখে সং সেজে করে উৎপাত লাফ দিতে গিয়ে সে হলো চিৎপাত’Ñএমনই অবস্থা বর্তমান সমাজের অধিকাংশ কিশোরদের তারা চুলে রং মেখে সং সেজে শহরের অলিতে গলিতে উৎপাত করে বেড়ায়, গণমাধ্যমে তাদের কিশোরগ্যাং নামে চিহ্নিত করা হয়।

কয়েক বছর ধরেই আলোচনায় ‘গ্যাং কালচার’। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বেপরোয়াভাবে সক্রিয় এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্কুল পড়ুয়ারা এসব গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। কারণ এ বয়সে ছেলেমেয়েদের আচরণ পরিবর্তিত হয়, তাদের মধ্যে এক ধরনের ‘বড় হয়ে গেছি’ বা ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব চলে আসে। তাছাড়া সময়ের সঙ্গে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। কিশোর গ্যাং ছিন্নমূল পরিবারের বিপথগামী সন্তান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীও রয়েছে। তারা তুচ্ছ ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে সহিংসতায়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের অপরাধগুলোর রূপ বদলাচ্ছে, হিংস্র হচ্ছে, নৃশংস হয়ে দেখা দিচ্ছে। অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘবদ্ধভাবে। ছিনতাই করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না?হত্যা করে ফেলছে সেই নিরীহ ব্যক্তিকে, ধর্ষণ করে খুন করে ফেলছে। এলাকায় নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনে স্থানীয় নেতা বা প্রভাবশালী বড়ভাইদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠেছে এসব কিশোর গ্যাং কালচার। কাউকে গালি দিলে বা সিনিয়রদের জুনিয়ররা যথাযথ সম্মান না দেখালে মারামারির ঘটনা ঘটছে, মেয়েলি সংক্রান্ত বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার প্রয়োজনে কিশোর বন্ধুরা মিলে প্রথমে একটি গ্রুপ তৈরি করে। পরে একসঙ্গে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের প্রয়োজনে অস্ত্র বহন ও ফাঁকা ফায়ারিং করে এবং গ্রুপ করে মোটরসাইকেল নিয়ে দেয়া হয় মহড়া।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘ল্যানসেট চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট হেলথ’ এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছে, কৈশোর শুরু হয় ১০ বছর বয়সে।

বাংলাদেশে ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচারে’ জড়িতদের বয়স ১০-১৭। এই কিশোরেরা নিজেদের মতো করে নতুন এক সমাজ গড়ে তুলছে। ওই সমাজের সংস্কৃতি, ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চলাফেরা সবই যেন স্বাভাবিকের চেয়েও ভিন্ন। এর বড় উদাহরণ হলো কিশোরগ্যাংগুলোর নামগুলোÑযেমন, বিগবস, নাইন এমএম, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ, মারাত্মক ‘কিশোর গ্যাং’-সহ ইত্যাদি ভিনদেশি শব্দের নাম।

কিশোরগ্যাং মূলত বিপথগামী ও পিতা-মাতার অবাধ্য একদল কিশোরের দল। তারা সর্বদা একত্রে চলাফেরা করে এবং যাবতীয় অপরাধ কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়। তাদের এই দল গঠিত হয় মূলত অনলাইন গেমস অথবা দলবদ্ধভাবে মাদক সেবনকে কেন্দ্র করে। শহরের অলিগলির নির্দিষ্ট একটি স্থান বাছাই করে তারা একত্রে পাবজি বা ফ্রি ফায়ারের মতো অনলাইন গেমস খেলে থাকে সেই থেকেই তারা একটি দলে পরিণত হয়, অথবা তারা নির্দিষ্ট একটি স্থান বাছাই করে একত্রে মাদকদ্রব্য সেবন করে থাকে সেই থেকেই তারা একটি দলে পরিণত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে তাদের দল ভারী হতে থাকে এবং তারা নিজেদের শহরের কিং বা ডন ভাবতে  শুরু করে দেয়।

ব্যস এখন তাদের আটকায় কার সাধ্য! তারা শহরে উৎপাত শুরু করে দেয়, তাদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে শহরবাসী। পাবলিক প্লেসে উচ্চৈঃস্বরে অসামাজিকভাবে একে অপরের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করা, উচ্চৈঃস্বরে একে অপরকে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করা, স্কুল কলেজে পড়ুুয়া কিশোরী অথবা তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা অর্থাৎ অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় যত প্রকারের অপরাধ রয়েছে তার কোনোটিই ছাড়েন না এই রং মেখে সং সাজা রাজপুত্ররা। তাদের এহেন কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে কেউ তাদেরকে বাধা দিতে আসলেই ঘটে বিপত্তি. প্রতিবাদকারী ব্যক্তি ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধারণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। দিনকে দিন কিশোরগ্যাংয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শুধু শহর নয়, গ্রামগঞ্জেও এই কিশোর দৌরাত্ম্য লক্ষ করা যায়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তাদের দলীয় নামেরও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। এটাই উপযুক্ত সময় এখনই তাদের লাগাম টানতে হবে, এখনই তাদের লাগাম না টানলে তারা আরও বেপরোয়া এবং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য হুমকিস্বরূপ। তাদের লাগাম টানতে কেবল পুলিশি অভিযানই যথেষ্ট নয়, পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি পরিবার এবং সমাজকেও এই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবারেরই উচিত সেই পরিবারের কিশোরদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, এবং তাদের যাবতীয় কার্যাবলি সর্বদা পর্যবেক্ষণ করা; তারা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে কাদের সঙ্গে মিশছে; কাদের বন্ধু বানাচ্ছে এসকল বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ করা পরিবারের দায়িত্ব।

এছাড়া সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের বিরুদ্ধে নানান সামাজিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। তাদের কোনো উদ্ভট আচরণ দেখামাত্রই সমাজের লোকেরা একত্রিত হয়ে তাদের নিবৃত্ত করতে পারে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা কিশোরগ্যাং থেকে নিষ্ক্রিদ্ধয় হয়ে যাবে। পাশাপাশি পুলিশ ও প্রশাসনকেও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পুলিশের উচিত স্কুল চলাকালীন শহরের পার্কগুলোতে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করা, কেননা তাদের অধিকাংশই স্কুল চলাকালীন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পার্কে নিয়ে আড্ডা বা মাদক সেবনে মত্ত হয়ে থাকে। মোটকথা পরিবার সমাজ পুলিশ ও প্রশাসন সবার প্রচেষ্টায় এই কিশোরগ্যাংয়ের লাগাম টানা সম্ভব। কিশোরগ্যাংয়ের বিরুদ্ধের এ লড়াইয়ে এ চার দল চার দিক থেকে আক্রমণ করলে কিশোরগ্যাংয়ের পরাজয় অবধারিত।

মাহমুদুল হাসান সারোয়ার

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়