মো. জিল্লুর রহমান: সম্প্রতি পটুয়াখালীর বাউফলে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে দশম শ্রেণির দুই মেধাবী শিক্ষার্থী হƒদয়বিদারকভাবে নিহত হয়েছে এবং আরও একজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, বুধবার (২২ মার্চ) বিকাল ৪টায় বাউফল উপজেলার সূর্যমণি ইউনিয়নের ইন্দ্রকুল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, ওইদিন বিদ্যালয়ে এসএসসি শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান ছিল এবং অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিকালে স্কুলের পাশে একটি ব্রিজের ওপর গায়ে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এ হামলার ঘটনা ঘটায়। খবরে প্রকাশ, হামলাকারীরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং এরা বিভিন্ন জায়গায় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়ায়। এরা ঠিকমতো স্কুলে যায় না।
আসলে সারাদেশেই উঠতি কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটা অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা পাড়ামহল্লা ও বাজারের অলিগলিতে আড্ডা এবং বিভিন্ন সময় অপরাধ ঘটিয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়। এসব অঘটনের পর বিব্রত হয় স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অভিভাবক। জানা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে আদনান কবির হত্যার পর এই ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সামনে আসে। ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’ নামে সক্রিয় এসব কিশোর শুরুতে মূলত ‘পার্টি’ করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো এবং রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে যুক্ত ছিল। এর পর থেকে এসব গ্রুপের ব্যাপ্তি ক্রমেই বেড়েছে। ১৫-২০ বছর বয়সী কিশোরদের প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ২০ জন করে সদস্য থাকে। বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং বিগত বছরগুলোয় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বারবার নানা ঘটনার জš§ দিয়ে আলোচনায় এসেছে।
বিগত কয়েক বছরে বখাটে কিশোর গ্যাং কালচার মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে দিনভর বখাটেরা আড্ডায় মেতে ওঠে। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অলিগলিতে বখাটে ও কিশোর গ্যাংস্টারের উপদ্রব উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এ কারণে ছাত্রীরাও প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। যৌন হয়রানির মুখে অনেক ছাত্রী পড়াশোনা ছাড়তেও বাধ্য হচ্ছে। শুধু যৌন হয়রানি নয়, কিশোর গ্যাংস্টাররা অপরাধ কর্মকাণ্ডে বেপরোয়া হয়ে ওঠায় অনিরাপদ হয়ে উঠেছে জনজীবন। প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করতে গিয়ে খুনখারাবির মতো ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিশোরদের গ্যাং কালচারের উৎপাত নিয়ে বেশ বিব্রত ও উদ্বিগ্ন।
এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও বয়সই আঠারোর বেশি নয়। কেউ পড়াশোনা করে, কেউ ব্যবসা করে, আবার কেউ কিছুই করে না। বেপরোয়া তাদের স্বভাব, কথাবার্তা ও চলাফেরাও বেশ উগ্র। এলাকায় নিজেদের অবস্থান জানান দিতে তারা দলবেঁধে চলে। ইভটিজিং থেকে শুরু করে এই কিশোররা জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধমূলক কাজে। এরই মধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় আলোচনায় এসেছে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবনকে রঙিন করতে, না বুঝে অনেকেই পা বাড়ায় এই ধ্বংসের পথে।
মূলত কিশোর গ্যাং শহরের অলিগলিতে চায়ের দোকান বা বিশেষ কিছু স্থানে অবস্থান নেয়। তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত সংগঠিত হচ্ছে নানা অপরাধ। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চুরি, ইয়াবা সেবন, ছিনতাই, মদ বিক্রি ও সেবন, জিম্মি রেখে টাকা আদায়সহ ভয়ংকর সব অপরাধ করে বেড়ায় কিশোর গ্যাং বা সন্ত্রাসী গ্রুপ। বখাটেপনা বা কিশোর গ্যাং অপরাধ দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে শহরে। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করার উপায় না থাকায় অভিভাবকরা চরম শঙ্কিত।
কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা নিরসনে সর্বপ্রথম এর কারণ চিহ্নিত করা দরকার। অনেকে বলছেন পারিবারিক সুশিক্ষা ও নৈতিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এর জন্য মূলত দায়ী। এক্ষেত্রে পরিবারকে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকতে হবে। পরিবারে কিশোরদের একাকী বা বিচ্ছিন্ন না রেখে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে বাবা-মাকে। সন্তান কী করে, কার সঙ্গে মেশে, কোথায় সময় কাটায়Ñএ ক’টি বিষয়ে পর্যাপ্ত মনিটর করতে পারলেই গ্যাংয়ের মতো বাজে কালচারে সন্তানের জড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব। এর বাইরে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
আসলে বর্তমান সমাজে পরিবারের দায়িত্ববোধ কমে যাওয়ায় এবং এর গুরুত্বকে খাটো করে দেখায় এর প্রতি সদস্যদের আকর্ষণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর ফলে বাবা-মা-ভাইবোন কেউই কারও প্রতি মায়া-মমতা, ভালোবাসা বা যথাযথ দায়িত্ববোধ অনুভব করছে না। বস্তুবাদী এ সমাজের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। বাবা-মা উভয়েই চাকরি ও অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছে না। ফলে ছেলেমেয়েরা অভিভাবক বা বড়দের পরোয়া করছে না। সামান্য ব্যাপারেই পারিবারিক ব্যবস্থায় ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা সেগুলো অনুসরণ ও অনুকরণ করছে এবং পরে এগুলো তাদের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ন্যূনতম মনুষ্যত্ব ও মানবতা বোধের পরিচয় দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। পরিবার থেকে পাচ্ছে না মানুষ হওয়ার প্রকৃত শিক্ষা। বাবা-মা উভয়েই চাকরিজীবী হওয়ায় তারা অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও সন্তানের সুশিক্ষায় নজর দিতে পারছে না। ফলে সন্তানরা গৃহশিক্ষক কিংবা গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে থেকে নৈতিক মূল্যবোধ তথা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অনেকের সন্তান বিপথে চলে যাচ্ছে, যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলছে।
মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত মায়ের কোলে শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবার মানবসন্তানের প্রথম শিক্ষানিকেতন। পরিবার থেকেই সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জš§ নেয়। বাবা-মা যেমন আদর্শ লালন করে, তাদের সন্তানরাও সেটা ধারণ ও লালন করার চেষ্টা করে। পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের মতো যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল, যা বাইরের যাবতীয় পঙ্কিলতা ও আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।
একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়, মেধাবী হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও নাম কুড়ানো যায়; কিন্তু পরিবার থেকে সুশিক্ষা না পেলে একসময় সব শিক্ষাই ম্লান হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো পারিবারিক নৈতিক সুশিক্ষা। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতাÑএগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ লালনপালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে।
বর্তমানে পরিবার ও সমাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে চরিত্রহীনতার দিকটি বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। মা-বাবা, ভাইবোন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ চরিত্রের প্রয়োজনে ধর্মীয় দিকটির গুরুত্বকে একেবারে গুরুত্বহীন মনে করেন। অথচ পরিবার ও সমাজের যুবকদের চরিত্র গঠনের জন্য বাবা-মা, কর্তাব্যক্তিদের এগিয়ে আসার কথা। কেবল মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলের জন্য লোকদেখানো প্রচারণা চালালে হবে না, বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য চরিত্র গঠনে ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণ ও যুবসমাজকে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে, যা অসুন্দর, দৃষ্টিকটু বা রুচিহীন, সেসবকে ইসলাম বা কোনো ধর্ম কখনও সমর্থন করে না। বরং সেগুলোকে বর্জন করতে উৎসাহী করতে হবে। মানুষকে পরিপূর্ণরূপে চরিত্রবান করে তুলতে ধর্মীয় অনুশাসনের কোনো বিকল্প নেই।
বহু মা-বাবা ও অভিভাবক আছেন সন্তানের জন্য অনেক কিছু করেন। কিন্তু তাদের সন্তানের চরিত্র গঠনের দিকটিকে একেবারে উপেক্ষা করে যান, মোটেও গুরুত্ব দেন না। ধর্মকে গতানুগতিক বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। ফলে এর প্রভাব পড়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিটি বাঁকে। চরিত্রবিধ্বংসী সব কাজকে তারা আগলে নেয়। জড়িয়ে পড়ে অনৈতিক সব কর্মকাণ্ডে। চরিত্র গঠনের জন্য তাই আমাদের বেশি বেশি ধর্মীয় বিধিবিধান ও পুস্তকাদি অধ্যয়ন করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বর্তমান সময়টি ফেসবুক ও ইন্টারনেটের। এ যুগে কিশোর ও উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের পক্ষে নিজেদের চরিত্র ঠিক রাখা কষ্টসাধ্য ব্যাপারই বটে। তবে ধর্মীয় বিধিবিধানকে মেনে চলতে পারলে চরিত্রকে সুন্দর করে তোলা কঠিন কাজ নয়। অনেক লোক আছেন যারা ধর্মের কথা বললেই অস্বস্তিতে ভোগেন, নাক সিটকানÑএটা হীনম্মন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধই পারে মানুষের চরিত্রকে আলাদাভাবে প্রকাশ করতে, যোগ্য করে গড়ে তুলতে।
নিজের পরিবার ও সমাজে সুশিক্ষা ও ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে তরুণদের চরিত্র গঠন আরও সহজ হবে। কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। কারণ পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় পরিবেশের অভাবে অনেকে বিপথগামী হয়, দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর আইনের প্রয়োগ করলেই চলবে না, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পারিবারিক সুশিক্ষা ও নৈতিক ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সচেতন অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সমাজ থেকে কিশোর অপরাধের মতো গ্যাং কালচার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
ব্যাংকার ও কলাম লেখক