কুটির ও হস্তশিল্পজাত পণ্য রফতানিতে প্রণোদনা

নাজমুল হোসেন: মানবসভ্যতার ইতিহাস ও ক্রমবিবর্তনের ধারার সঙ্গে মৃৎশিল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য শত-সহস্র বছর আগের। ধারণা করা হয় মধ্যপ্রাচ্যেই সর্বপ্রথম মাটির পাত্র তৈরি হয়। মধ্যপ্রাচ্যেই সবচেয়ে উন্নতমানের অলংকৃত মৃৎপাত্র তৈরি হতো দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের সুসা অঞ্চলে। মিসর, মেসোপটেমিয়া ছাড়াও সিন্ধু তীরবর্তী এলাকা, চীন, পারস্য ও এশিয়া মাইনরের বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাস কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন। আর বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের ইতিহাসও সমৃদ্ধ, বহু প্রাচীন। অথচ দিনের পর দিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প, হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্প।

একসময় এ শিল্পই ছিল অনেকের বেঁচে থাকার সম্বল, রুটি-রোজগারের একমাত্র অবলম্বন। পরিবেশবান্ধব এসব পণ্য যেমন সস্তা ছিল, তেমনি ছিল সৌন্দর্যবর্ধক। একটা সময় ছিল যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মেলা, পূজা-পার্বণ প্রভৃতি স্থানে গেলেই চোখে পড়ত বাহারি ও চোখধাঁধানো নানারকম হস্তশিল্পের উপকরণ। যেমনÑমাটির কলসি, সানকি, সরা বা ঢাকনা, ছোট-বড় তাগার, হুক্কা, বিভিন্ন রকম পুতুল, দেবদেবীর মূর্তি, গার্হস্থ্য দ্রব্য, মাটির ভাস্কর্য, টালি, শখের হাঁড়ি, মনশাঘট, ফুলদানি ইত্যাদি। আজ আর আগের মতো মেলা, পূজা-পার্বণে এসব মাটির তৈরি জিনিস তেমন একটা চোখে পড়ে না। গুটিকয়েক বিক্রেতাকেই দেখা যায় এসব পণ্য নিয়ে বসতে। আর এখন বড় বড় শহরের কিছু অভিজাত হ্যান্ডিক্রাফটসের শোরুমেই কেবল এসব পণ্যের কিছুটা চোখে পড়ে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। মানুষ আজ ঝুঁকে পড়েছে এর বিকল্প হিসেবে প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পরিবেশবিধ্বংসী পণ্যের দিকে। নিত্যব্যবহার্য জিনিস, ঘরের নানারকম আসবাবপত্র ব্যবহারেও মানুষ এখন একরকম বাধ্য হয়েই প্লাস্টিক, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি পণ্য ব্যবহার করছে। ফলে ন্যায্য দাম না পাওয়া, সময়মতো কাঁচামাল না পাওয়া, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা, স্বল্প সুদের পরিবর্তে চড়া সুদে কঠিন শর্তে ঋণ প্রভৃতি কারণে ঐতিহ্যবাহী এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ফলে অনেকেই আজ বেকার এবং এই শিল্প আজ একরকম বিলুপ্তির পথে। আর আমরা পরিবেশকেও ঠেলে দিচ্ছি ধ্বংসের মুখে।

হস্তশিল্প রফতানিতে ভালো সম্ভাবনা থাকলেও দ্রুত এগুতে পারছে না দেশ। ২০১০ সালের পর থেকে গত পাঁচ-ছয় বছরে এ খাতের রফতানি আয় দ্বিগুণ হয়েছে, তবে এখনও আশানুরূপ মাইলফলক স্পর্শ করতে পারেনি। যদিও সারা বিশ্বে হস্তশিল্পের আনুমানিক এক হাজার ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি বাজার রয়েছে। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন অনেকটা অগোছালোভাবেই সারা দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো প্রদর্শন ব্যবস্থা না থাকায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে এসব তৈরি পণ্যের অধিকাংশই পৌঁছায় না। এছাড়া পণ্যের নকশা, কারুশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য নেই কোনো প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে শণ, বাঁশ ও বেতের চাষ কমে যাওয়ায় কাঁচামালের সংকট প্রকট হচ্ছে। জানা যায়, হস্তশিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত, যাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব নকশা উন্নয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র আছে। সেখানে বৈশ্বিক গতিপ্রকৃতি বিবেচনায় নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন করা হয়। আমাদের দেশে হস্তশিল্পের মধ্যে বিভিন্ন রকম বস্ত্র, যেমনÑশাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ধুতি, নকশিকাঁথা, মশারি, তোয়ালে, উপজাতীয় বস্ত্র, মসলিন, জামদানি, মলমল টরোয়ো শাড়ি, পাবনার শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, কাতান, রেশমবস্ত্র, খদ্দর বস্ত্র ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এছাড়া হাতপাখা, মোড়া, সোফাসেট, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, শীতলপাটি, ছাইদানি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এগুলোর অনেক পণ্যের ওপরেই আবহমান গ্রামবাংলার প্রকৃতি, রূপ ও সৌন্দর্যকে কারুকাজের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়, যেগুলোর দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশের ভেতরে রয়েছে কারুপণ্য রংপুর, ঢাকা ট্রেড, আস্ক হ্যান্ডিক্রাফটস, কুমুদিনী, আড়ং, নিপুণ ক্রাফটস, ক্রিয়েশন্স সান ট্রেডসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, যারা হস্তজাত পণ্য রফতানি করছে। বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বাংলাক্রাফট) তথ্যানুযায়ী, শতরঞ্জি, পাটের তৈরি থলে, পাপোশ, টেরাকোটা, বাহারি নকশিকাঁথা, বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী, ঝুড়ি, বেল্ট, চামড়ার তৈরি মুদ্রার বাক্স-সহ বিভিন্ন পণ্য রফতানি করছেন এসব উদ্যোক্তা। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক বাজারে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকলেও বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এগুতে পারছে না।

তাই এসব শিল্পকে বাঁচাতে হলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে কাক্সিক্ষত মাইলফলক ছোঁয়া যাবে। সেজন্য স্থানীয়ভাবে এই শিল্পের কাঁচামাল অর্থাৎ বাঁশ, বেত, শণ ইত্যাদি চাষে সংশ্লিষ্টদের স্বল্প সুদে ঋণ, সরকারিভাবে খাস জমি বরাদ্দ এবং হস্তশিল্প গবেষণা ও ডিজাইন উন্নয়নে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। ফলে গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পে আবারও প্রাণ ফিরে আসবে, পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার মাধ্যমে বেকারত্বের হার কমবে এবং দেশের ও আন্তর্জাতিক বাজার দখলের মাধ্যমে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

প্রকৌশলী ও প্রাবন্ধিক

nazmulhussenÑyahoo.com