কুষ্টিয়ায় পানি সংকটে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা

কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। কুষ্টিয়া জেলাজুড়ে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে জেলার নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুরে পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানির অভাবে জমি ফেটে চৌচির। পুড়ে যাচ্ছে ফসল। কয়েক মাস অনাবাদি পড়ে আছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। জেলাজুড়ে কৃষকদের মধ্যে চলছে পানির জন্য হাহাকার। তীব্র তাপপ্রবাহে ঝরে যাচ্ছে আম ও লিচুর গুটি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ। পানি সংকটের সমাধান করা না গেলে আগামী আউশ মৌসুমে ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা নেই।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, কুষ্টিয়ায় চলতি মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমি। কিন্তু পানি সংকটের কারণে আবাদ হয়নি প্রায় ৬ হাজার বিঘা জমি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে মিরপুর উপজেলায়। সেখানে বোরো মৌসুমে অনাবাদি প্রায় ৩ হাজার ৩২২ বিঘা জমি। এ ছাড়া কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ১ হাজার ১২৫ বিঘা ও কুমারখালী উপজেলায় ৭৬৫ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়নি।

এদিকে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। কিন্তু পানি সংকটের কারণে আউশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও দিয়েছে শঙ্কা। বর্তমানে তাদের হাতে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও জেলার তিন উপজেলায় কয়েক হাজার বিঘা আউশের জমি ফাঁকা পড়ে আছে। দ্রæত পানি সমস্যার সমাধান না হলে এসব জমিতে চাষাবাদ সম্ভব নয়।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ী এলাকার কৃষক ইজাবুল হক বলেন, জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করছি। দুই বিঘা জমিতে সবজি ও কলা গাছ রয়েছে। জমির পাশে জিকে ক্যানাল থাকলেও পানি নেই। জমির সঙ্গে বরিং বসিয়েও কাজ হচ্ছে না। স্তর নেমে যাওয়ায় সেখান থেকেও পানি উঠছে না। পানির অভাবে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর কয়েক দিন গেলে সব শুকিয়ে যাবে।

একদিকে জিকে ক্যানালে পানি নেই, অন্যদিকে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ পাম্প দিয়ে উঠছে না পানি। মাঠের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে অধিকাংশ পাম্প। দীর্ঘদিন নষ্ট হয়ে বন্ধ রয়েছে জিকে প্রকল্পের তিনটি পাম্পই। এ কারণে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে জিকে ক্যানেল। তীব্র তাপপ্রবাহে কোথাও পানির অভাবে মাঠেই পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফসল।

জেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠ ধান তীব্র খরায় শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির অভাবে শত শত বিঘার ঢ্যাঁড়শ, বেগুন, করলা, ঝিঙে লাল শাক, ডাঁটা শাকসহ সব সবজি নুয়ে পড়েছে। ফলন্ত এসব ফসলে পানি দিতে না পেরে কৃষকদের মধ্যে চলছে হাহাকার।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, বর্তমানে মাঠে সবজিসহ ধান, পাট, ভুট্টা, কলা, আখসহ বিভিন্ন ফসল রয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহে এসব ফসল জমিতেই পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

কুষ্টিয়ার কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল বলেন, পানি সংকটের কারণে বোরো আবাদ ব্যাহত হয়েছে। দ্রæত সমস্যার সমাধান করা না গেলে আউশ উৎপাদনেও প্রভাব পড়বে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টি না হওয়া এবং তীব্র তাপপ্রবাহে ভ‚গর্ভস্থ পানি স্তর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এ বছর পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দিন ধরে কুষ্টিয়া অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, শহরেও পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। শহরের হাউজিং এলাকার বাসিন্দা মাহবুব রহমান বলেন, অনেকে নিজের পয়সায় সাবমারসিবল বসিয়ে পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। একটা সাবমারসিবল বসাতে অর্ধলাখ টাকা খরচ হয়। আমরা পারি না। পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে।

চলমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খরার মধ্যে ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে অবস্থান করছে। জিকের সব পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি সংকটের মধ্যে পড়েছেন কৃষকরা। কবে নাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে নিশ্চিত নয়।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের পাম্প ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন, কারিগরি ত্রæটির কারণে তিনটি পাম্প বন্ধ রয়েছে। পাম্পগুলো সচল করার চেষ্টা চলছে। কবে নাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান বলেন, পানি সংকটের কারণে উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে এ সমস্যা থাকবে না। দুই-এক দিনের মধ্যে বৃষ্টি হলেই সংকট কেটে যাবে। অন্যদিকে জিকে সেচ প্রকল্প চালু করতেও কাজ চলছে।