কুষ্টিয়ায় মধু আহরণে ব্যস্ত মৌ খামারিরা

কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ায় সরষে ক্ষেতে মধু আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৌ-খামারিরা। এ অঞ্চলে সরষে ক্ষেত থেকে মধু আহরণ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এতে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ মানসম্মত খাঁটি মধু উৎপাদিত হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষেতে মৌমাছি বিচরণের ফলে পরাগায়ণের মাধ্যমে বাড়ছে সরষের উৎপাদন। তবে সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিলে সরষের উৎপাদন আরও বাড়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ মধু বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, কুষ্টিয়াসহ পশ্চিমের ছয় জেলা তথা মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও যশোরের বিভিন্ন মাঠে প্রায় দুই হাজার বাক্স বসিয়ে এই মৌসুমে সরষে ক্ষেতে মৌ চাষ করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত থেকে উৎপাদিত হবে কমপক্ষে প্রায় ৫০ টন মধু। চলতি মৌসুমে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও যশোর জেলায় মোট ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে সরষে চাষ করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের বিত্তিপাড়া মাঠের দুই পাশ জুড়ে বিস্তীর্ণ সরষে ক্ষেত। এর মাঝেই ১ মাস আগে বসানো হয়েছে মৌমাছি চাষের ২০০ বাক্স। মৌমাছির দল আস পাশের সরষে ক্ষেতে উড়ে উড়ে মধু সংগ্রহ করে বাক্স বন্দি মৌচাকে জমা করছে। আর সেখান থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হচ্ছে মান সম্মত খাঁটি মধু।
কথা হয় মৌ খামারী শাহজাহান আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, দেড় মাস ধরে এই মধু সংগ্রহ চলবে। তিনি আশা করছেন এবার কমপক্ষে ৪টন মধু উৎপাদন হবে তার খামারে।

তিনি আরও জানান, স্থানীয় ভাবে এই মধু ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে উৎপাদিত মধুর বেশির ভাগটায় ভারতে রফতানি করা হয়। পরে এই মধু বিভিন্ন কোম্পানির নামে বাজারজাত হয়। তখন বাংলাদেশে সেই মধু কিনতে হয় ৭০০/৮০০ টাকা কেজি দরে। শাহজাহানের এই মৌ খামার থেকে প্রতিদিনই স্থানীয় মানুষ মধু কিনে নিয়ে যায়। অনেকে শখের বসেও এই খামার দেখতে আসেন।
স্থানীয় কৃষক হারুন আলী জানান, মৌ চাষের এই দৃশ্য তাদের উদ্বুদ্ধ করছে। মৌ চাষে তাদের মধ্য আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আগামীতে তারাও এই পদ্ধতিতে মধু আহরণের উদ্যোগ নিবেন বলে জানান।

একই এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরষে খেতে মৌমাছি চাষ করে মধু আহরণের বিষয়টি আগে আমাদের জানা ছিল না। সরকারী সহযোগীতা পেলে আমরাও মৌচাষে উদ্যোগী হবো। এদিকে, সরষে খেত থেকে মধু আহরণ করে সেই মধু বিক্রি করে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার গেটপাড়া গ্রামের মামুন অর রশিদ। উন্নয়ন সংস্থার চাকুর ছেড়ে মামুন থেকে পরিচিতি পেয়েছেন মধু মামুন নামে। মামুন সরষে খেতেই মৌমাছির মৌবক্সের মাধ্যমে মধু আহরণ করেন এবং সেখান থেকেই তা বিক্রি করেন।

মামুন জানান, ১৯৯৭ সালে তার এক বন্ধুকে সঙ্গে দিয়ে মাত্র ২ হাজার ৬০০ টাকায় ৪টি মৌবক্স কিনে মৌমাছি পালন শুরু করেন। পরে মৌ চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন মধু আহরণের কাজ। আস্তে আস্তে তার আয় বাড়তে থাকে। বর্তমানে তার খামারে কয়েকশ মৌমাছির বক্স রয়েছে। গড়ে তুলেছেন মিষ্টি মৌ খামার।

সরেজমিন দেখা যায়, বিস্তৃত সরষে মাঠে চলছে মধু আহরণ। সরষে খেতের মধ্যে ফাকা একটু জায়গায় বেশ কিছু মৌবক্স রাখা। সেখানে পুরো মাঠেই মৌমাছির আনাগোনা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেসব বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে।
মামুন বলেন, প্রথমে শখের বসে ২ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে মাত্র ৪টি মধুর বাক্স কিনে সরষে ফুলের মধু সংগ্রহ শুরু করি। এরপর আত্মকর্মসংস্থান এবং কিছু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে মধুর বাণিজ্যিক চাষ শুরু করি।

তিনি আরও বলেন, প্রতি কেজি সরষে ফুলের মধু ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সাধারণ উপায়ে মধু সংগ্রহ করতে গেলে মধুর মান ৪০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মধু আহরণে প্রযুক্তির ব্যবহার করলে মধুর মান অক্ষুণ্ন থাকে। আবার মৌ চাষের মাধ্যমে সরষে খেত থেকে মধু আহরণ করলে মৌমাছির মাধ্যমে ভালো পরাগায়ন হয় এবং সরষের ফলনও বাড়ে।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রূপালি খাতুন জানান, খেতে পাশের লাখ লাখ মৌমাছি থাকায় তারা ফুলে ফুলে বসে সুষ্ঠু পরাগায়নে সাহায্য করছে। এতে সরষের ফলন ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, এলাকার চাষিদের মধ্যে মৌচাষে যথেষ্ঠ আগ্রহ দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে অনেক কৃষক এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেছেন।

কুষ্টিয়া কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সূফী রফিকুজ্জামান জানান, সরষে খেতে মৌচাষের মতো সম্ভাবানাময় খাতকে তারা যুগোপযোগি পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তা ভাবনা করছেন। আগামীতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই চাষ শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।