কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া: কোথাও রয়েছে পানি নিষ্কাশনের নালা আবার কোথাও নালা থাকলেও দখলে-দূষণে তা দিয়ে পানি বের হয় না। ফলে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় প্রায় ৫১০ হেক্টর কৃষিজমি বছরে প্রায় সাত থেকে আট মাস থাকে পানির নিচে। সেখানে কৃষকরা সারা বছরে কেবল রবি মৌসুমে প্রায় দুই হাজার ৮০৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করেন। কিন্তু পানি নিষ্কাশন করা গেলে একই জমিতে বোরো ও আমন এই দুই মৌসুমে আরও প্রায় ছয় হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ, যার বাজারমূল্য (প্রতিকেজি ৩৩ টাকা দরে) ধরা হলে টাকার হিসেবে প্রায় ১৯ কোটি ৮০ লাখ হয়। তবে আধুনিক পদ্ধতিতে হাইব্রিড জাতের চাষাবাদ করলে আরও বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস।
কৃষকদের অভিযোগ, পদ্মা ও গড়াই নদী দ্বারা বেষ্টিত এ উপজেলায় ছোট-বড় সব মিলিয়ে অসংখ্য গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (জিকে) খাল রয়েছে। তবে নেই পরিকল্পিত নালা। আবার যতটুকু আছে, তাও সংস্কারে উদ্যোগ নেই। কেউ ভরাট করে বসতি গড়েছেন। আবার কেউ কেউ নালায় বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন। ফলে তিন ফসলি কৃষিজমিতে বছরের প্রায় সাত থেকে আট মাস পানি জমে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। এক দশক ধরে এভাবে চলে এলেও প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি কারও নেই সমাধানের উদ্যোগ। এতে দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে খাদ্য উৎপাদন। প্রতিবছরই লোকসান গুনছেন কৃষকরা। তারা দ্রুত সমস্যা সমাধানের দাবি জানান।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ২৪০ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে প্রায় ৫১০ হেক্টর জমিতে বছরে সাত-আট মাস হাঁটুসমান পানি জমে থাকে। তার মধ্যে নন্দলালপুর ইউনিয়নে ১৫০, সদকীতে ১০০, জগন্নাথপুরে ৮০, শিলাইদহে ৭০, যদুবয়রাতে ৬০ এবং চাপড়া ইউনিয়নে ২০ হেক্টর। সেখানে কৃষকরা বছরে মাত্র একবার ধান চাষ করেন। ফলে প্রতি বছর প্রায় ছয় হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে কৃষকরা পড়েছেন ক্ষতির মুখে।
সম্প্রতি চলতি মাসের গত ১৫ অক্টোবর সরেজমিনে স্থানীয় করাতকান্দি, গোবিন্দপুর, বহলবাড়ীয়া, চাঁদপুর, বাঁশআড়া, বাঁখই ও জগন্নাথপুর বিলে গিয়ে দেখা যায়, বিলে জমে আছে থৈ-থৈ পানি। সেখানে কচুরি, কলমি, শাপলাফুলসহ নানা রকম উদ্ভিদ জšে§ছে। কেউ ডিঙি নৌকায় চড়ে মাছ ধরছেন। কেউ আবার রবি মৌসুমে চাষের জন্য আগাছা পরিষ্কার করছেন। চাষাবাদে লোকসান হওয়ায় অনেকেই বিল-পুকুর কেটে মাছ চাষ করছেন। বিলসংলগ্ন এলাকার ড্রেনেজ খালজুড়ে কাটা হয়েছে পুকুর, নির্মাণ করা হয়েছে বসতবাড়ি। সংস্কারের অভাবে মৃতপ্রায় খাল দিয়ে পানি গড়ায় না।
কথা হয় স্থানীয় নন্দলালপুর ইউনিয়নের বহলবাড়ীয়া বিলের ষাটোর্ধ্ব কৃষক মসলেম উদ্দিনের (৬০) সঙ্গে। এই কৃষক বলেন, বিলে তার নিজের ও বর্গা পাঁচ বিঘা জমির চাষ আছে। বছর দশেক আগে খাল ছিল, ঘাঙে (নদী) পানি চলে যেত। তখন বছরে তিনবার ধান হতো। এখন খাল বন্ধ হয়ে পানি বের হয় না। কোনোমতে এক ফসল হয়। এতে তেমন লাভ হয় না।
সদকী ইউনিয়নের করাতকান্দি নামক বিলে সাড়ে তিন বিঘা জমি চাষ রয়েছে কৃষক আজমত শেখের (৫৩)। তিনি বলেন, এক চাষে প্রায় ২২-২৫ মণ ধান পাওয়া যায়। এতে যা আয় হয়, তা জমির আগাছা পরিষ্কার করতেই ফুঁড়ো (শেষ) যায়। ১২ মাস চাষ করা গেলে বছরে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ মণ ফসল পাওয়া যেত।
বাঁখই গ্রামের কৃষক শমসের আলী (৫৫) বলেন, পাঁচ-সাত বছর আগে বিলের পানি বাখই-চাঁদপুর ও মির্জাপুর-হাসিমপুর খাল দিয়ে পদ্মায় চলে যেত। কিন্তু খালের অনেক স্থানে কেউ বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন, কেউ কেউ খাল বন্ধ করে রাস্তা, ঘরবাড়ি ও দোকানপাট নির্মাণ করেছে। সেজন্য আর পানি বের হতে পারে না। স্থানীয় নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান খোকন বলেন, খালজুড়ে কেউ বাড়ি করেছে, কেউ পুকুর খনন করেছে। সেজন্য কয়েক হাজার বিঘা জমি প্রায় সারা বছরই পানির নিচে থাকে। ফসল হচ্ছে না। তিনি খাল খননের জন্য উপজেলা প্রশাসনকে বারবার জানিয়েছেন। তবে কোনো লাভ হয়নি।
পরিকল্পিত নালার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস। তিনি বলেন, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এ উপজেলায় প্রায় ৫১০ হেক্টর কৃষিজমি বছরে সাত-আট মাস থাকে পানির নিচে। সেখানে কৃষকরা বছরে একবার শুধু রবি মৌসুমে প্রায় দুই হাজার ৮০৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করেন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম মিকাইল ইসলাম বলেন, পরিকল্পিতভাবে খাল খনন বা নালার জন্য এরই মধ্যে বিএডিসির সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তালিকা চলছে। খুব দ্রুতই কার্যক্রম শুরু করা হবে।