
এরশাদ নাবিল খান : সমাজতাত্ত্বিক কামরুদ্দীন আহমদ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টকে এই বাংলার হতদরিদ্র মানুষের জন্য বাস্তিল দুর্গের পতনের ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কামরুদ্দীন আহমদ ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক কর্মীর মতোই মুসলিম লীগের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের আধিপত্যকামী মানসিকতার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতি থেকে সরে যান।
কামরুদ্দীন আহমদকে এদেশের একেবারে প্রথম দিককার জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করা যায়, যিনি এদেশের ইতিহাসের স্বাতন্ত্র্যবোধকে আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি যে এই কাজে আন্তরিক ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানপন্থি বুদ্ধিজীবী প্রফেসর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের একটি বই থেকে। সেখানে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন কামরুদ্দীন আহমদের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছিলেন। এমনকি ইংরেজির অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন কামরুদ্দীন আহমদের ইংরেজি জ্ঞান নিয়েও তুচ্ছতাচ্ছল্য করেছিলেন।
যা হোক, কামরুদ্দীন আহমদ ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তিকে পূর্ববঙ্গের মানুষের জন্য বাস্তিল দুর্গের পতনের মতো মহা ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে যে তুলনা করেছিলেন, তাতে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।
আফসোসের বিষয় হচ্ছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশে ঘনীভূত হওয়া ভারত ও পাকিস্তানের প্রক্সি রাজনীতির জন্য ১৯৪৭ সাল এখন দেশে একটি স্পর্শকাতর ও মেরুকরণময় রাজনৈতিক প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে। ভারতপন্থিরা গোটা পাকিস্তান আন্দোলনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দ্বিজাতিতত্ত্বকে কাঠগড়ায় খাড়া করিয়েছে।
অপরদিকে পাকিস্তানপন্থিরা ১৯৪৭ সালকেই ইতিহাসের ফুলস্টপ ঘোষণা করে ১৯৭১ সালকে নেহায়েত হিন্দু ভারতের প্রযোজিত একটি নিচু স্তরের রাজনৈতিক কারসাজি হিসেবে প্রতিপন্ন করে এসেছে, যার দ্বারা নাকি এদেশের মানুষ দ্বিজাতিতত্ত্ব খারিজ করে একজাতিতত্ত্বের গোলামি অবলম্বন করেছিল।
উভয় শিবিরের এহেন আত্মঘাতী কর্মতৎপরতায় ভারত বা পাকিস্তান থাকলেও নেই বাংলাদেশ। এসব অপতৎপরতার বিষময় প্রভাবে বাংলাদেশের আজকের প্রজš§ ১৯৪৭ সালে মূলত এদেশের আপামর জনসাধারণ কর্তৃক চালিত একটি জনগণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ধুলার আস্তরণ ছাড়া আর কিছু দেখতে পারে না। এখনকার প্রজšে§র ইতিহাস জ্ঞানের এহেন মারাত্মক খামতি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে পথ চলার প্রতিটি পদক্ষেপে সর্বদা রক্তচক্ষু ব্যাদান করে রেখেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, আজকের বাংলাদেশে বসেই বরং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে সদর্পে রিক্লেইম করার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে রয়েছে। তাতে পাকিস্তানপন্থি হওয়ার কোনোই প্রয়োজন নেয়। স্রেফ বাংলাদেশপন্থি হয়েই এটা করা যায়। কারণ পাকিস্তান আন্দোলন কখনোই এতটা ত্বরান্বিত হতো না, যদি এতে বাংলার সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান না থাকত।
১৯৩৩ সালে লন্ডনে কেমব্রিজ শিক্ষার্থী চৌধুরী রহমত আলীর পুস্তিকা ‘ঘড়ি ড়ৎ ঘবাবৎ; অৎব ডব ঃড় খরাব ড়ৎ চবৎরংয ঋড়ৎবাবৎ’ এত দিনে মহাকালের কবরের মাটিতে মিশে যেত, যদি তা পরবর্তীকালে জনসমর্থনে বলীয়ান না হতো, যে জনসমর্থনের বহিঃপ্রকাশ একমাত্র বাঙালিরা প্রদর্শন করতে পেরেছিল।
আর বাংলার মানুষ নিজেদের মুক্তি এবং উল্লম্ফনের আকাক্সক্ষাতেই পাকিস্তান আন্দোলনের সামনের সারিতে পৌঁছেছিল, যে আকাক্সক্ষা তাদের ২৩ বছর পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে অনুপ্রাণিত করে।
পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল বাঙালিরাই। অন্য জাতি শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে থাকায় এবং আশরাফ-ঐতিহ্যে বলীয়ান থাকায় হয়তো পাকিস্তান আন্দোলনে নেতা সরবরাহ করেছে, কিন্তু জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ দিতে পারেনি। অবশ্য তারপরও পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা প্রান্ত হিসেবে পরিগণিত লাহোর প্রস্তাব একজন বাঙালি নেতাই উত্থাপন করেছিলেন। এমনকি পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দলটিরই প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ঢাকায়, ১৯০৬ সালে ঢাকার নবাবের পৌরহিত্যে।
এসব আমাদের জন্য একান্ত গর্বের বিষয়; এবং এর অসংকোচ স্বীকারোক্তিতে পাকিস্তানের সামনে বাংলাদেশ ইনফেরিয়র হয়ে যায় না, বরং পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসে পাকিস্তানের বিপরীতে বাংলাদেশের উচ্চাসন নিশ্চিত করে।
উপমহাদেশে ভারতীয় একজাতীয়তা এখন একটি মৃত বিষয়। অন্যরা নয়, খোদ ভারতীয়রাই আজ তাদের চর্চিত অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তথা একজাতিতত্ত্বের কফিন তৈরি করছে। কাশ্মীরের মানুষের মতো বাংলার মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও কখনও একজাতিতত্ত্ব গ্রহণ করেনি। এটা আমাদের বিষয় কখনও ছিল না, এখনও নেই।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির মাধ্যমে ঘটি-বাটি ভিন্ন হলেও মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভক্তি বহু আগেই, বোধকরি বাঙালি হিন্দু রেনেসাঁর সময়েই ত্বরান্বিত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ একজাতিতত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা এদেশে থাকার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। কিন্তু রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্যে বলীয়ান হয়ে এই মৃত বিষয়কে টেনে এনে বিভ্রান্তির জš§ দেয়া হয়েছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বও এখন পত্রপল্লবে বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বহু ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যেও টিকে যাওয়া উপমহাদেশের জন্য সঠিক তত্ত্বের খোঁজ দিয়েছে। তা হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়া এমন একটি কমনওয়েলথ, যাতে কেবল ধর্মই নয়, ভাষা বা নৃতাত্ত্বিকতার নিরিখেও বহু জাতি বিদ্যমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দ্বিজাতিতত্ত্বকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি, বরং দ্বিজাতিতত্ত্বকে বহুজাতিতত্ত্বে বিকশিত করেছে। বাংলাদেশের লক্ষ্য দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি খেলা নয়, বরং একটি অভূতপূর্ব জন-আন্দোলনে বাংলাদেশের মানুষের কৃতিত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নিহিত।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা-সংগ্রাম আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বিরাট ঘটনার একটি। ১৫৭৬ সালে রাজমহলে গঙ্গার তীরে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খোয়ানোর ৩৯৫ বছর পর ১৯৭১ সালে বাংলার একটি খণ্ডিতাংশে হলেও আবার একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তির পত্তন ঘটেছিল।
১৯৭১ সালকে এই দৃষ্টিতে অবলোকন করার মতো দম এদেশে কারও নেই। এর কারণ এখানে বছরের পর বছর চলা পাক-ভারতের প্রক্সি রাজনীতি।
এই ৩৯৫ বছরের প্রতিটি ঘটনাই ধীরে ধীরে ১৯৭১ সালকে তৈরি করেছে, যার সর্বশেষ বড় ধাপ ছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা এবং তাতে কার্যত জীবন্ত জনরায়ের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের শামিল হওয়া। ইতিহাসের কোনো স্তরকেই আমরা অস্বীকার যেমন করতে পারব না, তেমনি কোনো ঘটনার চেয়ে কোনো ঘটনা বড়, সেই বিষয়ে বালখিল্য বাহাসে লিপ্ত থাকাও আমাদের চলবে না।
ওপরে যে জনরায়ের কথা বলা হলো, তা ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলোয় অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে অখণ্ড ভারত দাবি আর পাকিস্তান দাবির পক্ষে-বিপক্ষের গণভোট হিসেবে দেখা হয়েছিল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সামনে এই নির্বাচন ছিল একজাতিতত্ত্ব ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর হতে চলা চূড়ান্ত লিটমাস টেস্টের মতো। অথচ সেই নির্বাচনে কেবল বাংলায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মোট মুসলিম ভোট ও আসনের ৯৫ শতাংশ লাভ করেছিল মুসলিম লীগ। এটা সম্ভব হয়েছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অপরিসীম পরিশ্রম ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে।
পাকিস্তানের দাবির জনভিত্তি পরখের সেই নির্বাচনে খয়বর পখতুনখোয়ায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে খান আবদুল গাফফার খানের বড় ভাই খান আবদুল জব্বার খানের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়। তখন এই প্রদেশের নাম ছিল উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ।
পরবর্তী সময় পাকিস্তানে খবরদারি কায়েম করা প্রদেশ পাঞ্জাবে ১৯৪৬ সালের মহা ঐতিহাসিক নির্বাচনে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। মালিক খিজির হায়াত টিওয়ানার নেতৃত্বে স্থানীয় দল পাঞ্জাব ইউনিয়নিস্ট পার্টি, কংগ্রেস ও শিখ সংগঠন শিরোমণি আকালী দলের জোট সরকার হয়।
সিন্ধুতে মুসলিম লীগ কিছুটা বেশি আসন পেলেও দলটিকে সরকার গঠন করতে স্থানীয় দল মুসলিম পিপলস পার্টির সঙ্গে সমঝোতার পথে যেতে হয়। এর ফলে সিন্ধু মুসলিম পিপলস পার্টির নেতা গোলাম হোসেন হেদায়েত উল্লাহ সরকার গঠন করেন।
চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যে বিভক্ত হওয়ায় বেলুচিস্তানে কোনো নির্বাচন হয়নি।
এই নির্বাচনকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একটি অগ্রবর্তী জনরায় হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ এটি পাকিস্তান দাবির প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হলেও কেবল বাংলার মানুষই অখণ্ড ভারত থেকে আলাদা হওয়ার পক্ষে দৃঢ় ও স্পষ্ট মত দেখাতে পেরেছিল। ভারত বিভক্তির মাত্র বছরখানেক আগের তেমন জটিল সময়েও যে দৃঢ় এবং নিরঙ্কুশ মত অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশের জনগণ দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ যে দুর্বিনীত লক্ষ্মী ছাড়াই থাকবে এবং ভবিষ্যতেও নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখবে, তার প্রথম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৪৬ সালের নির্বাচনেই।
আজ পাকিস্তান আন্দোলনে কৃতিত্ব বাংলাদেশের লোকদের চেয়ে সেসব প্রদেশের লোকদের বেশি, এমনটা ভাবা ওসব প্রদেশের লোকজনের জন্য ততটা লজ্জার নয়। তারা তেমন ফুটো আত্মপ্রসাদে ভুগতেই পারে। কিন্তু এটা শতভাগ পরিহাস, পরিতাপ ও লজ্জার বিষয় বাংলাদেশের কতিপয় লোকের, যারা এমনটা মনে মনে ধারণ করে; এবং সেই সূত্রে এটাও মনে করে যে, ১৯৭১ সালে বাঙালি পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে বেইমানি করেছে!
ভারত ও পাকিস্তানের প্রক্সি রাজনীতির ফরমাবরদারদের জন্য এদেশের মানুষ এদেশের ইতিহাসের পথধারা থেকে কতটা বিচ্যুত হয়ে আছে, তা উপরিউক্ত আলোচনা থেকে কিছুটা হলেও স্পষ্টতা পেতে পারে।
বিগত বছরগুলোয় এদেশে যে রাজনীতিশূন্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা দেশের রাজনীতিতে একটি মহা প্রতিস্থাপনের ঘনঘটা সৃষ্টি করেছে। এই ঘনঘটায় বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে পাকিস্তান ও ভারতের প্রক্সি রাজনীতির বিলোপ ঘটুক এবং এসবের ধ্বংসস্তূপে বিশ্বের বৃহত্তম এই জাতিতাত্ত্বিক ছিটমহলের স্বীয় গৌরব আর শক্তিকে সমুন্নত করার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হোকÑএই দৃঢ় কামনা ও আশাবাদ আমি আমৃত্যু পোষণ করে চলব। এই রাজনীতিতে বাংলাদেশকে কারও ঐতিহাসিক লেজুড়ে পরিণত করার কূটকৌশল থাকবে না, থাকবে বাংলাদেশকে একটি মহান ও অমিততেজা জাতিতে পরিণত করার কর্মোদ্যম…।
[মতামত লেখকের নিজস্ব। শেয়ার বিজ কড়চার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ না-ও হতে পারে]
রাজনৈতিক বিশ্লেষক