Print Date & Time : 6 July 2025 Sunday 1:09 am

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকস: নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ

হেনা শিকদার: বিগত কয়েক দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি আমাদের জীবনযাত্রায় এনেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই এবং রোবোটিক্স)। এই দুটি প্রযুক্তি আজ আর কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির অংশ নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতি স্তরে ধীরে ধীরে নিজেদের অপরিহার্য করে তুলছে। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে জটিল শিল্পকারখানা, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে কৃষিক্ষেত্রÑসর্বত্রই এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকসের জয়জয়কার। তবে এই প্রযুক্তির যেমন অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনই কিছু ঝুঁকিও বিদ্যমান। তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের এখন থেকেই ভাবতে হবে, কীভাবে এই প্রযুক্তিকে নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় করে তোলা যায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে কম্পিউটারের মাধ্যমে অনুকরণ করার একটি প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে কম্পিউটার নিজে থেকে শিখতে পারে, সমস্যা সমাধান করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যা ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখছে।
যেমন, চ্যাটজিপিটি-সহ কয়েকটি এআই নতুন ডেটা ও কনটেন্ট তৈরি করতে, ভয়েস তৈরি করতে, ভাষা বিশ্লেষণ করতে, বুঝতে ও তৈরি করতে এবং গ্রাফিক ডিজাইন, গেম ও ওয়েবসাইট তৈরি করতে অভাবনীয় অবদান রাখছে।
রোবোটিক্স হলো সেই ক্ষেত্র যেখানে রোবট নামক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের নকশা, নির্মাণ, পরিচালনা ও প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করা হয়। ১৯৬০ সালের পর থেকে রোবট ধীরে ধীরে উৎপাদনশিল্প, চিকিৎসা এবং সামরিক, গৃহস্থালি এমনকি মহাকাশ অনুসন্ধানে ব্যবহƒত হতে শুরু করে। বর্তমানে রোবটিকস কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), সেন্সর প্রযুক্তি, মেশিন লার্নিং ও মাইক্রো ইলেকট্রনিকসের সহায়তায় দ্রুত উন্নতি করছে।
আজকের বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকসের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোগ নির্ণয়কে আরও নির্ভুল ও দ্রুত করেছে। রোবোটিক সার্জারি জটিল অপারেশনকে আরও সূক্ষ্ম ও নিরাপদ করে তুলেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন দিগন্ত উšে§াচন করেছে। শিল্পকারখানায় রোবট উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত, সাশ্রয়ী ও ত্রুটিমুক্ত করেছে। কৃষি ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় কীটনাশক স্প্রে করা থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে রোবটের ব্যবহার বাড়ছে। পরিবহন ব্যবস্থায় চালকবিহীন গাড়ি ও ড্রোন ডেলিভারি খুব শিগগিরই হয়তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠবে। এছাড়া গ্রাহক পরিষেবা, বিনোদন, নিরাপত্তা ও মহাকাশ অনুসন্ধানের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকস নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। তবে এই প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কিছু ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জও উঠে আসছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো কর্মসংস্থান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকসের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনেক কাজ হয়তো মানুষের হাত থেকে চলে যাবে। বিশেষ করে পুনরাবৃত্তিমূলক ও শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজগুলোয় এর প্রভাব বেশি পড়বে। এর ফলে বেকারত্বের হার বাড়তে পারে এবং সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নৈতিক দিক নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠছে। অ্যালগরিদমের পক্ষপাতিত্বের কারণে বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া, ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ভুল তথ্য বা বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা ছড়ানোÑএগুলো সবই উদ্বেগের কারণ। মানুষের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দিন দিন সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তিকে কমিয়ে দিতে পারে। রোবট যদি মানুষের নিয়ন্ত্রণে না থাকে এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা লাভ করে, তাহলে তা অপ্রত্যাশিত এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকসের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় করে তুলতে প্রয়োজন সমন্বিত এবং দূরদর্শী পদক্ষেপ। প্রথমত, আমাদের প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নীতি কাঠামো এবং আইনি বিধিমালা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত, যা নৈতিকতা, ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা এবং অ্যালগরিদমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ বিষয়ে একটি চুক্তি হওয়া উচিত; দ্বিতীয়ত, শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য এমন শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যা তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকসের যুগে টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত করবে। প্রযুক্তিগত দক্ষতার পাশাপাশি সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের মতো মানবিক গুণাবলি বিকাশের ওপর জোর দিতে হবে। যারা কর্মচ্যুত হবেন, তাদের জন্য নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত, গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করার জন্য উন্নত অ্যালগরিদম ও সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। মানুষের সঙ্গে রোবটের সহযোগিতা ও মিথস্ক্রিয়া কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়েও গবেষণা চালাতে হবে; চতুর্থত, সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকসের সুবিধা এবং ঝুঁঁকি সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। ভুল ধারণা ও ভয় দূর করতে সঠিক তথ্য এবং জ্ঞান সরবরাহ করতে হবে; পঞ্চমত, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকস একটি বৈশ্বিক বিষয় এবং এর সমাধানে সকল দেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সেরা অনুশীলনগুলো ভাগ করে নেয়ার মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকস প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং জটিল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এর সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগাতে হলে আমাদের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়