Print Date & Time : 2 August 2025 Saturday 8:02 pm

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী এবং কেন?

মো. আরাফাত রহমান: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা অনুকৃত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এখন হয়ে উঠেছে একটি একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্র। এখানে কম্পিউটারকে মিমিকস কগনেটিক এককে আনা হয়, যাতে করে কম্পিউটার মানুষের মতো ভাবতে পারে।

মেশিন যখন ক্রমবর্ধমানভাবে সক্ষম হয়ে ওঠে, তখন মানসিক সুবিধার জন্য বুদ্ধিমত্তাকে সংজ্ঞা থেকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়। বর্তমানে যে সক্ষমতাগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো মানুষের বক্তব্যকে সফলভাবে বুঝতে পারে, কৌশলগত গেম সিস্টেম যেমন দাবা বা উচ্চতর স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি চালাতে পারে এবং সামরিক সিমুলেশন ও জটিল উপাত্ত ব্যাখ্যা করতে পারে। এআই গবেষণাকে কতগুলো উপশাখায় বিভক্ত করা যেতে পারে, যা নির্দিষ্ট সমস্যা, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ সরঞ্জামের ব্যবহার বা নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনগুলোর দিকে ফোকাস করে।

যান্ত্রিক বা আনুষ্ঠানিক যুক্তি অধ্যয়ন প্রাচীনকালে দার্শনিক ও গণিতবিদদের দ্বারা শুরু হয়। গাণিতিক যুক্তিবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালান টুরিং গণিতের এ তত্ত্বের সূত্রপাত করেন, যেখানে একটি মেশিন ‘০’ ও ‘১’ প্রতীক চিহ্ন দ্বারা গাণিতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর মাধ্যমে যে ডিজিটাল কম্পিউটার আনুষ্ঠানিক যুক্তির কোনো প্রক্রিয়া অনুকরণ করতে পারে, তা চার্চ-টুরিং থিসিস হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। স্নায়ুবিদ্যা, তথ্য তত্ত্ব এবং সাইবারনেটিক্সের আবিষ্কার গবেষকদের মধ্যে বৈদ্যুতিক মস্তিষ্ক নির্মাণের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। এআই গবেষণার ক্ষেত্র ১৯৫৬ সালে ডার্টমাউথ কলেজের একটি কর্মশালায় প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। অ্যালেন নিউয়েল, হারবার্ট সিমন, জন ম্যাকার্থি, মার্ভিন মিনস্কি ও আর্থার স্যামুয়েল এআই গবেষণার প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতা হয়ে ওঠেন।

একবিংশ শতকের প্রথম দিকে সরবরাহ, ডেটা মাইনিং, চিকিৎসা নির্ণয় এবং অন্যান্য কাজের জন্য এআই ব্যবহার করা শুরু হয়। সাফল্য ছিল গণনায় ক্ষমতা বৃদ্ধি, নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান, অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে নতুন সম্পর্ক এবং গবেষকদের গাণিতিক পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক মানকে একটি প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড় করানো। ‘ডিপ ব্লু’ মেশিন ১৯৯৭ সালে তৎকালীন দাবা চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে পরাজিত করার মাধ্যমে প্রথম কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত দাবা খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। আলফাগো জিরো সফটওয়্যার তিন দিন ধরে নিজের বিরুদ্ধেই ‘গো’ নামক একটি বোর্ড গেম খেলার পরে দক্ষতার দিক থেকে সুপার-হিউম্যান পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এক্সিসটেনশিয়াল রিস্ক সেন্টার বলছে, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই পদ্ধতি যতই শক্তিশালী হয়ে উঠবে, ততই এটি অতি বুদ্ধির অধিকারী হয়ে উঠবে। এটি হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যাবে।’

কম্পিউটার দ্রুতই উন্নত পরিসংখ্যান কৌশল, বড় পরিমাণে তথ্যের মধ্যে প্রবেশ এবং শিক্ষা ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করে। ২০১০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে মেশিন লার্নিং অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করা হতো। ২০১৫ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য একটি মাইলফলক বছর ছিল। গুগলের মধ্যে এআই ব্যবহার করার জন্য দুই হাজার সাতশ’রও বেশি প্রকল্পে স্পোরাইডিক ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে ত্রুটির হার ২০১১ সাল থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। ক্লাউড কম্পিউটিং অবকাঠামোর উত্থানের ফলে এবং গবেষণা সরঞ্জাম ও ডেটাসেটগুলোর বৃদ্ধির কারণে সাশ্রয়ী মূল্যের স্নায়বিক নেটওয়ার্কগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য উদাহরণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মাইক্রোসফটের স্কাইপে সিস্টেমের ডেভেলপমেন্ট যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে পারে এবং ফেসবুক সিস্টেম অন্ধ মানুষদের কাছে চিত্রের বর্ণনা করতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সামগ্রিক গবেষণার লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তি তৈরি করা, যার মাধ্যমে কম্পিউটার ও মেশিন বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতিতে কাজ করতে সক্ষম হবে। বুদ্ধিমত্তার উৎপাদন বা তৈরির ক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যাগুলোকে কয়েকটি উপ-সমস্যায় বিভক্ত করা হয়েছে। যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা ক্ষমতা রযেছে, তা একটি বুদ্ধিমান সিস্টেম প্রদর্শন করবে বলে গবেষকরা আশা করেন। প্রাথমিক গবেষকরা অ্যালগরিদম বিকশিত করেছেন, যা ধাপে ধাপে যুক্তিযুক্ত করে, যেমন করে মানুষ সমস্যা সমাধান বা যুক্তি খণ্ডনের জন্য সেগুলো ব্যবহার করে। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এআই গবেষণাকে উন্নত করা হয় মূলত অনিশ্চিত বা অসম্পূর্ণ তথ্য, সম্ভাবনা ও অর্থনীতি থেকে ধারণা করার জন্য।

কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য অ্যালগরিদমগুলোর প্রচুর গণনীয় তথ্য প্রয়োজন। এছাড়া সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা সংযুক্ত করতে সক্ষম মেমরি বা কম্পিউটারের নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট আকারের সমস্যা সমাধানের জন্য। এ কারণে আরও দক্ষ সমস্যা সমাধানের অ্যালগরিদম অনুসন্ধান অনেক বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। মানুষ ধাপে ধাপে করার পরিবর্তে প্রাথমিকভাবে দ্রুত, স্বনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ব্যবহার করেছে এবং প্রাথমিক এআই গবেষণা সেই মডেলটিকে একটি রূপ দিতে পেরেছে। এআই সাব-সিম্বোলিক সমস্যা সমাধান ব্যবহার করে অগ্রগতি অর্জন করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অঙ্গবিন্যাসকারী এজেন্ট উচ্চতর যুক্তি থেকে দক্ষতার ওপর জোর দেয়, যা মস্তিষ্কের ভেতরকার কাঠামোর অনুকরণে গবেষণার প্রচেষ্টা করে, কারণ এআইয়ের প্রধান উদ্দেশ্য  হলো মানুষের ক্ষমতা অনুকরণ করা।

জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব ও জ্ঞানের প্রকৌশল এআই গবেষণার কেন্দ্রীয় বিষয়। অনেক সমস্যার সমাধান যে মেশিন দ্বারা করা হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়, তার বিশ্ব সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। যে ধরনের বিষয় এআই প্রতিনিধিত্ব করবে তা হলো বস্তু, বৈশিষ্ট্য, বিভাগ ও বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক; পরিস্থিতি, ঘটনা, অবস্থা এবং সময়; কারণ ও প্রভাব; জ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান; এবং অন্যান্য গবেষণামূলক ডোমেইন। সর্বাধিক উচ্চতর তত্ত্ববিদ্যা তাকেই বলা হয়, যা অন্য সব জ্ঞানের ভিত্তি প্রদানের প্রচেষ্টা করে। জ্ঞানের প্রতিনিধিত্বের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সমস্যাগুলো হলো:

ক. যুক্তি ও যোগ্যতার সমস্যা: একটি পাখির কথা আলোচনায় মানুষ সাধারণত একটি প্রাণীকে চিত্রিত করে, যার কোনো বিশেষ আকার ও চিহ্ন আছে এবং যারা উড়তে পারে। এসব শর্ত সব পাখির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জন ম্যাকার্থি ১৯৬৯ সালে এ সমস্যা চিহ্নিত করেছিলেন যোগ্যতার সমস্যা হিসাবে। এআই গবেষণা এ সমস্যার সমাধানের জন্য চেষ্টা করেছে।

খ. কমনসেন্স জ্ঞানের বিস্তৃতি: এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে কম্পিউটারের মতো উৎস থেকে পড়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ধারণাগুলো বোঝার জন্য মেশিনের যথেষ্ট ধারণা থাকতে হবে এবং তার নিজের অ্যান্টোলজিতে যোগ করতে সক্ষম হতে হবে।

গ. সাধারণ জ্ঞানের কিছু প্রতীকী ফর্ম: মানুষ যা জানে তার বেশিরভাগই ঘটনা বা বিবৃতি হিসেবে উপস্থাপিত হয় না, যা তারা মৌখিকভাবে প্রকাশ করতে পারে। একজন দাবা মাস্টার একটি নির্দিষ্ট দাবা পরিসীমা এড়িয়ে চলবেন, বা একজন শিল্প সমালোচক একটি আঁকা ছবি দেখেই এটি জাল মনে করতে পারেন। এগুলো মানবমস্তিষ্কের অসচেতন এবং উপ-প্রতীকী স্বরূপ বা প্রবণতা। এ ধরনের জ্ঞান প্রদান মূলত প্রতীকী এবং সচেতন জ্ঞানের জন্য।

ঘ. পরিকল্পনা: ক্লাসিক্যাল পরিকল্পনা সমস্যাগুলোর মধ্যে এজেন্ট অনুমান করতে পারেন যে, এটিই একমাত্র সিস্টেম, যা বিশ্বজুড়ে কাজ করে এবং এজেন্টকে তার কাজের ফল নির্দিষ্ট করে দেয়। এটি একটি এজেন্টের জন্য যে শুধু তার পরিবেশের মূল্যায়ন ও পূর্বাভাস তৈরি করতে পারে তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে তার পূর্বাভাস মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে তা মেনে চলে। বহু এজেন্টের পরিকল্পনায় একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনেক এজেন্টের সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা ব্যবহার করে।

ঙ. শিক্ষা: মেশিনের শিক্ষণ এআই গবেষণার একটি মৌলিক ধারণা। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কম্পিউটার অ্যালগরিদম অধ্যয়ন, যা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্নতি করতে সক্ষম। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমগুলোর গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং তাদের পারফরম্যান্স কম্পিউটেশনাল লার্নিং থিওরি নামে পরিচিত, যা তাত্ত্বিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা।

সহকারী কর্মকর্তা

ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট

সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়