কৃষক বাঁচাতে ৫০ লাখ টন ধান কেনার পরামর্শ

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখার পাশাপাশি কৃষকদের বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে তাদের কাছ থেকে সরকারকে ৫০ লাখ টন ধান কেনার পরামর্শ দিয়েছেন একটি জাতীয় সংলাপের বক্তারা। জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল ‘ধানসহ কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে ওই পরামর্শ দেওয়া হয়।
সরকারের যথেষ্ট গুদাম না থাকলে প্রয়োজনে কৃষকদের কাছে ধান সংরক্ষণ ও পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রান্তিক কৃষকদের বিনা সুদে অন্তত তিন থেকে চার মাসের ঋণ দেওয়ার প্রস্তাবও এসেছে ওই সংলাপ থেকে।
জাতীয় সংলাপে অংশ নেন খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা। খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ আয়োজিত সংলাপে সভাপতিত্ব করেন পিকেএসএফ চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।
এবার বোরো ধান আবাদ করে উৎপাদন খরচ উঠছে না বলে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ চলছে। মাঠের পাকা ধানে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সংলাপে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘গতবার বোরো ধান মার খাওয়ার ফলে সরকার আমদানি সহজ করে দিয়েছিল। এর ফলে দেশে দুই লাখ টনের বেশি আমদানি করেছে। এখনও দুই লাখ টন চাল আমদানি পেন্ডিং রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে চাল কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার সরকারেরও ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য কম থাকায় বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষকরা মহাসমস্যায় পড়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ২০ শতাংশ বা ৫০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করলেই কৃষকদের বাঁচানো সম্ভব। সরকারের নির্ধারিত পাঁচ শতাংশ ধান কেনার লক্ষ্য নিয়ে কখনোই বাজারে প্রভাব রাখা সম্ভব নয়।’
‘ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তাৎক্ষণিক প্রণোদনা দেওয়ারও পরামর্শ’ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘শ্রমিকের মজুরি গত বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বিপরীতে সরকারের ধান কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা কৃষককে সংকটে ফেলে দিয়েছে।’
কৃষিবিদ আতাউর রহমান বলেন, ‘সরকারের গুদাম সমস্যা হলে প্রান্তিক কৃষকদের যার কাছে যা আছে তা কিনে নিয়ে তাদের ব্যবস্থাপনায় জমা রাখতে পারে। তারাই ওই ধান ভালো রাখার দায়িত্ব পালন করবে। পরে সরকারের যখন প্রয়োজন হবে তখন কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নেবে।’
খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতেও সরকার খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে থাকে। আমাদের সরকারও এক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়, কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে আমাদের কৃষকরা সেভাবে এর সুফল পান না। এর একটা বড় কারণ, কৃষকরা এদেশে অসংগঠিত। আমাদের বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও সমাজ গঠনে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক চিন্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানের যে সমাজতন্ত্র মুছে দিয়েছিল, তা শেখ হাসিনা সংবিধানে আবার ফিরিয়ে আনলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক গবেষণা পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা অনেক সুপারিশ করে থাকি, কিন্তু কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে তা গুরুত্বপূর্ণ। ধান ও চালের বাজারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, বিশেষত ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যায়। কৃষকদের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরের অভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক সংকট সমাধানে সরকারকে সংবেদনশীল মনে হয়নি। সরকার মাঠ থেকে দ্রুত প্রকৃত তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করতে পারত। সামর্থ্য না থাকলে গৃহস্থের ঘরেই ধান মজুদ রাখার উদ্যোগ নিতে পারত সরকার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মূল্য কমিশনের বেঁধে দেওয়া সুনির্দিষ্ট মূল্যে সরকারিভাবে অনেক পরিমাণে ধান কেনা হয়। আমরাও এরকম কমিশন গঠন করে সুফল পেতে পারি। ধান আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো-বাড়ানোর তাৎক্ষণিক সুফল কৃষকরা পান না। এক্ষেত্রে গবেষণা ও মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব।’
সভাপতির বক্তব্যে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘সরকার সরবরাহ সচেতন হলেও কৃষকদের চাহিদার ক্ষেত্রে কাজ করছে না। এজন্য কৃষকদের জন্য শক্তিশালী সংগঠন জরুরি। সামাজিক সংগঠন হিসেবে একসঙ্গে কাজ করার উদ্দেশ্যে কৃষকদের সংগঠন তৈরি করা দরকার। এছাড়া একটি মূল্য কমিশন গঠন করা দরকার, যা আন্তর্জাতিক ও দেশের বাজারের চাহিদা নিরূপণ মূল্য নির্ধারণ করবে।’