শেখ আবু তালেব: বড় ঋণে সবসময় আগ্রহ দেখায় ব্যাংক। কিন্তু কৃষিঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্তসহ বেসরকারি খাতের বেশকিছু ব্যাংক সফলতা দেখিয়েছে। এসবের মাঝে ১৫টি ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণে বরাবরই আগ্রহ কম দেখিয়ে আসছে। এর মধ্যে সাতটি ব্যাংকের আগ্রহ একেবারে তলানিতে নেমেছে। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সাতটি ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২০ শতাংশ বিতরণ করতে পেরেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বিতরণে পিছিয়ে থাকা এ তালিকায় রয়েছে মধুমতি ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ডাচ্ বাংলা ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। একইসঙ্গে দেশি-বিদেশি প্রায় ১৫ ব্যাংক ঋণ বিতরণে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এসব ব্যাংকের ঋণ বিতরণের হার ৫০ শতাংশেরও নিচে। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৬৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে।
আবার বিদেশি খাতের কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ও উরি ব্যাংক এখন পর্যন্ত এক টাকাও বিতরণ করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশের নিচে কৃষিঋণ বিতরণ করা অন্য ব্যাংকগুলো হলো বেসিক ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ডাচ্ বাংলা ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। আর ৩০ শতাংশের নিচে থাকা ব্যাংকগুলো হলো ন্যাশনাল ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক। ৪০ শতাংশের নিচে থাকা ব্যাংকগুলো হলোÑফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও দ্য সিটি ব্যাংক। আর ৫০ শতাংশের নিচে থাকা ব্যাংকগুলো হলোÑবেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংক।
দেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষি খাতের অবদান প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। এমনকি শিল্প ও সেবা খাতের অবদানের ক্ষেত্রেও কৃষির পরোক্ষ অবদান রয়েছে। কৃষি খাত খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি পুষ্টি সমস্যা সমাধান, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এমন বাস্তবতায় কৃষিকে গুরুত্ব দিয়ে এ খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে প্রতি বছর কৃষি ও পল্লিঋণ নামে নীতিমালা প্রণয়ন করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিমালার আওতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য পৃথক পৃথক লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছেÑবাংলাদেশে ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে কৃষকদের মাঝে লক্ষ্য অনুযায়ী ঋণ বিতরণে অনীহা রয়েছে কিছু কিছু ব্যাংকের।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৬টি ব্যাংকের কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি ও বিদেশি ৪৮ বাণিজ্যিক ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৬১ শতাংশ বা ১৭ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত খাতের আট ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩৯ শতাংশ বা ১১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। পল্লি অঞ্চলে শাখা বিস্তৃত না থাকায় বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো তাদের ঋণের সিংহভাগরই এনজিও’র মাধ্যমে বিতরণ করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের আট মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ১৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা, যা পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৬৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ১৮০ কোটি টাকা বা লক্ষ্যমাত্রার ৬১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ সময়ে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ৮ হাজার ২১০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে, যা তাদের মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৭৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো বিতরণ করতে পেরেছে ১১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা, যা তাদের লক্ষ্যমাত্রার ৬৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৫৬টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ১৫টি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের হার লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে সাত ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের হার ২০ শতাংশের নিচে, যার মধ্যে দুটি ব্যাংকের বিতরণ পরিস্থিতি শূন্য। ব্যাংক দুটি হলোÑবিদেশি খাতের কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ও উরি ব্যাংক। এর মধ্যে ব্যাংক অব সিলনের ঋণ বিতরণে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৬৬ কোটি ও উরি ব্যাংকের ১১ কোটি টাকা।
এদিকে, করোনার কারণে চলতি অর্থবছরে কৃষিঋণ আদায়ের হার কমে গেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের আট মাসে কৃষিঋণ আদায়ের হার ৬৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭০ দশমিক ৪০ শতাংশ।