ড. মো. আব্দুল মালেক: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে দেশের জনসংখ্যা আড়াইগুণে পৌঁছলেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কৃষির উৎপাদন। এ সাফল্যে রয়েছে কৃষিবান্ধব সরকারের সময়োপযোগী ও সঠিক পদক্ষেপ, পরিবর্তিত জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন, উপকরণের সহজলভ্যতা, উদ্ভাবিত ফসলের জাতের যথাযথ সম্প্রসারণ, গবেষকগণ এবং সচেতন কৃষক। বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) কৃষির এ সাফল্যের গর্বিত অংশীদার।
পারমাণবিক কলাকৌশলের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত সৃষ্ট খরা, লবণাক্ততা, অসম বৃষ্টিসহ আকস্মিক বন্যাজনিত কারণে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলা করে বিনা এ পর্যন্ত উদ্ভাবন করেছে ২১টি ফসলের ১২৮টি জাত, যার ৯৯টি নিউক্লিয়ার কৌশল ব্যবহার করে উদ্ভাবিত। উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে দানাজাতীয় ফসলের ২৭, ডাল ফসলের ৪০, তেল ফসলের ৩৪, সবজি ১৪, মসলার ৬, পাটের ২, লেবুর ৩ এবং ফলের ২টি, যার বেশিরভাগই স্থানীয় জাতের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ ফলন দিচ্ছে।
পারমাণবিক কৌশল তথা মিউটেশন প্রজনন পদ্ধতির মাধ্যমে বিনা উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতগুলো দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় বিশেষ অবদান রাখছে তা উল্লেখ করা হলো:
ধানের জাতসমূহ: উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মঙ্গা নিরসনে বিনা ২০০৭ সালে উদ্ভাবন করে উচ্চফলনশীল (গড় ফলন ৪.৮ টন/হে.) স্বল্প জীবনকালের বিনাধান-৭, যার মাধ্যমে মঙ্গা এলাকার কৃষকরা মঙ্গা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। বিনার পরবর্তী উদ্ভাবন হলো ১০০-১২০ দিনের বিনাধান-১৬, বিনাধান-১৭, বিনাধান-২২ ও বিনা ধান২৬ (গড় ফলন ৫.০-৬.৫ ট/হে.)। সাম্প্রতিক সময়ের উদ্ভাবন লম্বা ও চিকন চালের প্রিমিয়াম কোয়ালিটির বোরোধানের উচ্চফলনশীল বিনা ধান২৫ (গড়ে ৭.৬ টন/হে.), যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব হবে। স্বল্প জীবনকালের (১২০-১৪৫ দিন) উচ্চফলনশীল বোরোধান বিনাধান-১৪, বিনাধান-২৪ ও বিনা ধান২৫ (গড় ফলন ৬.৫-৭.৬ টন/হে.) চাষের ফলে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে। স্বল্প জীবনকালের (৯০-১০৫ দিন) উচ্চফলনশীল আউশধান বিনাধান-১৯ ও বিনাধান-২১ (গড় ফলন যথাক্রমে ৫.৫ ও ৪.৫ টন/হে.), যা চাষ করে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে। বন্যা-পরবর্তী নাবিতে রোপণযোগ্য বিনাশাইল এবং বিনাধান-২০ সেপ্টেম্বরে রোপণ করলেও হেক্টর প্রতি আশানুরুপ ফলন দিচ্ছে। আকস্মিক বন্যা সমস্যার সমাধানে বিনা উদ্ভাবন করেছে জলমগ্নতা সহিষ্ণু বিনাধান-১১ ও বিনাধান-১২ যেগুলো ২৫ দিন পর্যন্ত জলমগ্নতায় সহিষ্ণু বিধায় স্বাভাবিক ফলনের মাধ্যমে কৃষক আর্থিক ক্ষতি হতে রক্ষা পাচ্ছে। লবণাক্ত অঞ্চলে বোরো মৌসুমের পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে বিনার উদ্ভাবন উচ্চ লবণাক্ততা সহনশীল বিনাধান-৮ ও বিনাধান-১০ (লবণাক্ত জমিতে গড় ফলন যথাক্রমে ৫.০ ও ৫.৫ টন/হে.)।
লবণাক্ততা সহনশীল বিভিন্ন জাত: বিনাধান-৮ ও বিনাধান-১০ ছাড়াও লবণাক্ততা সহনশীল বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯ ও বিনা সরিষা১২ (গড় ফলন ১.৪-১.৮ টন/হে.), বিনাচিনাবাদাম-৬, বিনাচিনাবাদাম-৭, বিনাচিনাবাদাম-৮ ও বিনাচিনাবাদাম-৯ (গড় ফলন ১.৮-১.৯ টন/হে.), বিনাতিল-২, বিনাতিল-৪ (ফলন ১.১-১.২ টন/হে.), বিনাসয়াবিন-২, বিনাসয়াবিন-৫, বিনাসয়াবিন-৬, বিনা সয়াবিন৭ (গড় ফলন ১.৮-২.২ টন/হে.) চাষের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ পতিত জমি চাষের আওতায় আসছে।
ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিতে: দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তথা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমির দেশটিতে একই জমিতে বছরে ২টি’র স্থলে ৩টি এবং ৩টি’র স্থলে ৪টি ফসল উৎপাদন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিনা উদ্ভাবিত বিনাধান-৭, বিনাধান-২২ ও বিনা ধান২৬ (গড় ফলন ৪.৮-৬.৫ টন/হে.); বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১ ও বিনা সরিষা১২ (গড় ফলন ১.৬-২.০ টন/হে.) আর নাবিতে রোপণযোগ্য স্বল্প জীবনকালের বোরোধান বিনাধান-১৪, বিনাধান-২৪ ও বিনা ধান২৫ (গড় ফলন ৬.৫-৭.৬ টন/হে.) চাষের ফলে শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধিসহ ভোজ্যতেল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া বিনা উদ্ভাবিত জাত ব্যবহার করে বিভিন্ন অঞ্চলে চার ফসলভিত্তিক শস্যবিন্যাস উদ্ভাবনে অনেকক্ষেত্রেই সফলতা এসেছে, যার মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গতি আসছে।
খরাসহিষ্ণু জাত: দেশের চরাঞ্চলে বিনাতিল-২ ও বিনাতিল-৪ (গড় ফলন ১.২-১.৩ টন/হে.), বিনাচিনাবাদাম-৪, বিনাচিনাবাদাম-৬ ও বিনাচিনাবাদাম-৮ (গড় ফলন ২.৫-২.৯ টন/হে.) আশাতীত ফলন দিচ্ছে। খরা সহনশীল বিনাতিল-২ ও বিনাতিল-৪, বিনামুগ-৫, বিনামুগ-৭, বিনামুগ-৮, বিনামুগ-১১ ও বিনা মুগ১২ (গড় ফলন ১.৮-২.০ টন/হে.), বিনাছোলা-৪, বিনাছোলা-৬ ও বিনাছোলা-১০ (গড় ফলন ১.৬-১.৮ টন/হে.), বিনামসুর-৯, বিনামসুর-১০ ও বিনা মসুর১২ (গড় ফলন ১.৮-২.২ টন/হে.) দেশের খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকায় চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
ভোজ্যতেলে উৎপাদন বৃদ্ধি: দেশে প্রচলিত শস্যবিন্যাসে বিশেষ করে স্বল্প জীবনকালের উচ্চফলনশীল ও প্রতিকূলতাসহিষ্ণু বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯, বিনাসরিষা-১১ ও বিনা সরিষা১২ (গড় ফলন ১.৭-২.০ টন/হে.) জাতগুলো অন্তর্ভূক্ত করে ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া চাষবিহীন, রিলে পদ্ধতিসহ নাবিতে বপনযোগ্য, সাময়িক জলাবদ্ধতা সহনশীল ও রোগপ্রতিরোধী বিনাসরিষা-৪, বিনাসরিষা-৯ ও বিনা সরিষা১২ দক্ষিণাঞ্চলের এক ফসলি আমনধান চাষের পর এবং হাওর অঞ্চলের বোরোধান রোপণের আগে চাষের জন্য খুবই উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
মসলা ফসল: গ্রীষ্মকালীন বিনাপেঁয়াজ-১ ও বিনাপেঁয়াজ-২ (গড় ফলন ৮.৭-৮.২ টন/হে.), বিনারসুন-১ (গড় ফলন ১৩.৫ টন/হে.), বিনামরিচ-১ ও বিনামরিচ-২ (গড় ফলন ৩৩.০ – ৩০.০ টন/হে.) এবং বিনাহলুদ-১ (গড় ফলন ৩২.০ টন/হে.) জাতগুলো দেশের মসলার চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে।
বছরব্যাপী লেবু: বছরব্যাপী চাষযোগ্য সুঘ্রাণযুক্ত ও বীজবিহীন বিনালেবু-১, বিনালেবু-২ ও বিনালেবু-৩ (গড় ফলন যথাক্রমে ২৮, ৪২ও ৫১ টন/হে.) লেবুর উৎপাদন বৃদ্ধিতে রাখছে বিশেষ অবদান।
পুষ্টি নিরাপত্তা: বিনা উদ্ভাবিত জিঙ্ক-সমৃদ্ধ বিনাধান-২০, তেলবীজ (সরিষা, চিনাবাদাম, তিল ও সয়াবিন), ডাল (মসুর, খেসারি, মুগ, ছোলা ও মাষকলাই), সবজি (টমেটো ও পাটশাক), মসলা (পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, মরিচ) ও ফল (বিনা কুল১ ও বিনা সফেদা১) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানোসহ পুষ্টি নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
গামা রেডিয়েশন প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রুত পচনশীল ফল, ফুল ও সবজির সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণকালে পেঁয়াজ, রসুন ও আলুর গুণগতমান বজায় রেখে সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিসহ ওজন হ্রাসজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনতে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে অনেকটাই সফল হয়েছে, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় আরও বেশি অবদান রাখবে। যুগোপযোগী ভবিষ্যৎ গবেষণা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নসহ পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণসহ বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে বিনার বিজ্ঞানীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পরিচালক, গবেষণা বিভাগ
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহ
malekbinaÑgmail.com