রোহান রাজিব: দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে নিয়মিত কৃষিঋণের পাশাপাশি এ খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এ খাতে ৩৫ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম। তহবিল থেকে এখনও ঋণ বিতরণ শুরু করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে সিএমএসএমই খাতে মাত্র ১৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে। গত রোববার ব্যাংকার্স সভায় উপস্থাপিত পৃথক দুটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়।
এ দুটি খাতে ঋণ বিতরণ কম হওয়ায় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এ সময় সিএমএসএমই ও কৃষিতে ঋণ বিতরণ ত্বরান্বিত করতে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের তাগিদ দেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো (সিএমএসএমই) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। এ খাতকে সহায়তা করার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে অধিকতর গতিশীল করার জন্য সঠিক কৌশল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন, উদ্যোক্তাদের মাঝে সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি এবং উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা ধরনের পদক্ষপ গ্রহণ করেছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিএমএসএমইর সংজ্ঞা ও ঋণসীমা নির্ধারণসহ এ খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধি করতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ‘মাস্টার প্রজ্ঞাপন’ জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের মধ্যে সিএমএসএমইতে প্রতি বছর কমপক্ষে ১ শতাংশ বৃদ্ধিসহ আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে ন্যূনতম ২৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি সিএমএসএমইতে বিতরণ করা ঋণের ন্যূনতম ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোগে বিতরণ করতে হবে। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময় এ খাতে সহজশর্তে ঋণ বিতরণ নিশ্চিত করতে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ৬টি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। এগুলো হলোÑসিএমএসএমই খাতে মেয়াদি ঋণের বিপরীতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সিএমএসএমই খাতে চলতি মূলধন ঋণ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম, স্মল এন্টারপ্রাইজ খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম, কটেজ, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র খাতে নতুন উদ্যোক্তা পুনঃঅর্থায়ন তহবিল, কৃষিজাতপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য মফস্বলভিত্তিক শিল্প স্থাপনে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম এবং স্টার্ট-আপ ফান্ড শীর্ষক পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। এসব তহবিল থেকে ব্যাংকগুলোকে মাত্র ২ শতাংশ সুদে পুনঃঅর্থায়ন করা হচ্ছে। তারপরও সিএমএসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। এছাড়া নারী উদ্যোগে অর্থায়নও কাক্সিক্ষত মানে অর্জিত হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো বিভিন্ন খাতে যে ঋণ বিতরণ করেছে, তার ১৯ শতাংশের মতো গেছে সিএমএসএমইতে। কিছু কিছু ব্যাংকের ঋণ বিতরণ পরিস্থিতি এর চেয়েও অনেক কম রয়েছে। এছাড়া নারী উদ্যোক্তা খাতে ঋণ যাচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশেরও কম।
বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষিখাতের ওপর নির্ভরশীল। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান সাড়ে ১১ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কৃষি খাতের পরোক্ষ অবদান রয়েছে।
চলতি অর্থবছরে ৫৬ তফসিলি ব্যাংককে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ব্যাংকগুলো বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে ৯ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। এ সময়ে ২টি বিদেশি ব্যাংক কোনো ঋণ বিতরণ করেনি এবং ৩৩টি ব্যাংক আনুপাতিক হার (৩৩.৩৩%) এর নিচে বিতরণ করেছে। এছাড়া কৃষি খাতের জন্য গঠিত বিভিন্ন পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ঋণ বিতরণ পরিস্থিতিও হতাশাজনক।
কভিড মহামারিসহ অন্যান্য কারণে গ্রামে ফিরে যাওয়া জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যার গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার ৬ শতাংশ। এ পর্যন্ত স্কিমটির আওতায় মাত্র ১৬টি ব্যাংক অংশগ্রহণ করেছে এবং ঋণ বিতরণ করেছে মাত্র ৮৩ কোটি কোটি টাকা। গম ও ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত আগস্টে ১ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে, যার গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার ৪ শতাংশ। গত অক্টোবর পর্যন্ত এ স্কিমটির আওতায় ২০টি ব্যাংক অংশগ্রহণ করেছে এবং মাত্র সাড়ে ৯ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত নভেম্বরে কৃষি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে, গ্রাহক পর্যায়ে যার সুদের হার ৪ শতাংশ। এ তহবিল থেকে এখনও ঋণ বিতরণ শুরু করতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
গত রোববার ব্যাংকার্স সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষি খা?তে সর্বোচ্চ ঋণ সহযোগিতা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হ?য়ে?ছে। যেকোনো মূল্যে এ খাতের ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। যদি কোনো ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে তা পূরণের জন্য যাদের সক্ষমতা আছে, তাদের সহযোগিতায় এ লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।