Print Date & Time : 1 August 2025 Friday 8:17 pm

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বড় সম্ভাবনার হাতছানি

তারিক মাহমুদুল ইসলাম: দেশের কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। কৃষিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় হ্রাস, শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে শুরু করেছে কৃষক। জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই।

১৯৭০ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গবাদি প্রাণীর ব্যাপক প্রাণহানির পরিপ্রেক্ষিতে উপদ্রুত এলাকায় চাষাবাদের জন্য সীমিতসংখ্যক ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার বিতরণ করা হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালে দ্রুততম সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো নামমাত্র মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে ৪০,০০০ শক্তিচালিত লো-লিফ্ট পাম্প, ২,৯০০ গভীর নলকূপ এবং ৩,০০০ অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সম্প্রসারণের এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা কৃষি যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’ নামে একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন।

সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প। প্রকল্পটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার সব উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল জুলাই/২০২০ থেকে জুন/২০২৫ পর্যন্ত। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩০২০,০৬,৮৫,০০০.০০ (তিন হাজার বিশ কোটি ছয় লক্ষ পঁচাশি হাজার টাকা)। ৫ বছর মেয়াদের প্রকল্পটি জুন/২০২৫ পর্যন্ত চলবে।

প্রকল্পের লক্ষ্য

কৃষিকে ব্যবসায়িকভাবে অধিকতর লাভজনক ও বাণিজ্যিকভাবে টেকসই করে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য

হ আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সরবরাহ ও ব্যবহার বৃদ্ধি করে ফসলের ১০%-১৫% অপচয় রোধ এবং চাষাবাদে ৫০% সময় ও ২০% অর্থ সাশ্রয় করা।

হ সমন্বিতভাবে সমজাতীয় ফসল আবাদ করে কৃষি যন্ত্রপাতির ৫০% কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা।

হ কৃষি উৎপাদন ব্যয় হ্রাসকরণ এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।

হ যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে পোস্ট হারভেস্ট ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।

হ  ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ।

প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হলো, উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে ১২ ধরনের ৫১৩০০টি কৃষিযন্ত্র কৃষকে কাছে পৌঁছানো। এ প্রকল্পের মাধ্যমে হাওর (৭ জেলা, ৪৪ উপজেলা) ও উপকূলীয় (১২ জেলা, ৫৯ উপজেলা) এলাকায় ৭০% এবং অন্যান্য এলাকায় ৫০% উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে (ভর্তুকি মূল্যে) কৃষকদের মাঝে ১২ ক্যাটেগরির আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের উন্নয়ন সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে কম্বাইন হারভেস্টার (ধান ও গম এবং ভুট্টা), রিপার ও রিপার বাইন্ডার, রাইস্ ট্রান্সপ্লান্টার (ওয়াকিং টাইপ এবং রাইডিং টাইপ), পাওয়ার টিলারচালিত বেড প্লান্টার ও সিডার, পাওয়ার থ্রেসার, মেইজ শেলার, পাওয়ার স্প্রেয়ার, পাওয়ার উইডার, পটেটো ডিগার, ড্রায়ার এবং কেরোট ওয়াসার যন্ত্র সরবরাহ চলমান রয়েছে।

বর্তমানে প্রকল্পটি তৃতীয় বছর অতিক্রম করতে চলছে। এরই মধ্যে উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার কৃষিযন্ত্র কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। যন্ত্রগুলোর মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এরই মধ্যে প্রায় নয় হাজার কম্বাইন হারভেস্টার কৃষকদের মাঝে উন্নয়ন সহায়তায় বিতরণ করা হয়েছে।

কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্রটি বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলছে। যন্ত্রটি ১ ঘণ্টায় প্রায় ১ একর জমির ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই করতে পারে। যন্ত্র দ্বারা ১ একর জমির ধান কাটতে অঞ্চলভেদে ৪৫০০-৬০০০ টাকা খরচ পরে। সনাতন পদ্ধতিতে ১ একর জমির ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই করতে ১৮ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৭০০ টাকা ধরলে সনাতন পদ্ধতিতে ১ একর জমির ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই করতে প্রায় ১২৬০০ টাকার প্রয়োজন হয়। যন্ত্র দ্বারা ধান কর্তন করলে একরপ্রতি কৃষকের সাশ্রয় প্রায় (১২৬০০-৬০০০) = ৬০০০ টাকা।

কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা ধান কর্তনের ফলে ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় ১০% থেকে কমে ৩% হয়েছে। ফলে কৃষক ৭% ধান বেশি পাচ্ছে। হেক্টরপ্রতি ধানের ফলন ৫.৫ টন হলে কৃষক প্রতি হেক্টরে ৩৮৫ কেজি ধান বেশি পাচ্ছে। ধানের মূল্য ২৫ টাকা/কেজি হলে প্রতি হেক্টরে কৃষক বেশি পাচ্ছে ৯৬২৫ টাকা, যা একরপ্রতি ৩৮৯৬ টাকা। একরপ্রতি কৃষকের সাশ্রয় হচ্ছে (৬০০০+৩৮৯৬) = ৯৮৯৬ টাকা।

কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা ধান কর্তনের ফলে কৃষক কম সময়ে ফসল ঘরে তুলছে। সময়মতো ফসল সংগ্রহ করার ফলে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি অনেক হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ (শিলাবৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া, আকস্মিক বন্যা) থেকে ফসল রক্ষা পাচ্ছে। কৃষকের সময় সাশ্রয় হচ্ছে। কৃষকের অমানবিক ও কায়িক শ্রম হ্রাস পাচ্ছে। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় কৃষকের লাভের পরিমাণ বাড়ছে। সংগ্রহোত্তর অপচয় কম হওয়ায় কৃষক বেশি ধান পাচ্ছে; কৃষকের লাভের পরিমাণ বাড়ছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে যন্ত্র দিয়ে ধান কর্তনের পরিমাণ ছিল ৪%। সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭%-এ উন্নীত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমন মৌসুমে বাংলাদেশে আবাদকৃত জমির পরিমাণ ৫৭,৩০,৭৬৮.২ হেক্টর। কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা কর্তনকৃত জমির পরিমাণ ৬,৪২,৮৭০.৫১ হেক্টর, যা মোট আবাদকৃত জমির ১১.২২%। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে বাংলাদেশে আবাদকৃত জমির পরিমাণ ৪৯,৫৭,৮৪৯ হেক্টর। কম্বাইন হারভেস্টার দ্বারা কর্তনকৃত জমির পরিমাণ ১০,৯৯,১৬৭.৫ হেক্টর, যা মোট আবাদকৃত জমির ২২.১৭%। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমন এবং বোরো মৌসুমে হারভেস্টার দ্বারা ধান কর্তনের ফলে শস্যের অপচয় রোধ হয়েছে ৪,১৩,৭১৬.২৩ টন, যার বাজারমূল্য ১০১৮,৯৪,৫৬,৩০৭.৫০ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমন এবং বোরো মৌসুমে হারভেস্টার দ্বারা ধান কর্তনে কৃষকের সাশ্রয়ের পরিমাণ ১৬৯৫,৪২,২৫,০৮১.০০ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমন ও বোরো মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে কৃষকের মোট অর্থ সাশ্রয়ের পরিমাণ ২৭১৪,৩৬,৮১,৩৮৭.৫০ টাকা (দুই হাজার সাতশত চৌদ্দ কোটি ছত্রিশ লক্ষ একাশি হাজার তিনশত সাতাশি টাকা)।

যান্ত্রিকীকরণের সুফল পেতে হলে দক্ষ চালক ও মেকানিক তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ চালক ও মেকানিক তৈরির জন্য এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮ দিনব্যাপী ৯০০০ গ্রামীণ মেকানিককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩২১০ জন মেকানিককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০টি উপজেলায় ৩০০টি অটো রাইস সিড সোয়িং মেশিন এবং ৬ লাখ ট্রে; ট্রেতে চারা উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তার মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে (প্রতি উদ্যোক্তা ১টি মেশিন এবং ২০০০ ট্রে)। ফলে অনেক শিক্ষিত বেকার তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৭৫০ জন উদ্যোক্তাকে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্র-উপযোগী ধানের চারা উৎপাদনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে নারীরাও রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছেনএবং উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠেছেন।

আমাদের কৃষিজমি খণ্ড খণ্ড হওয়ায় আধুনিক কৃষিযন্ত্র পরিবহন ও পরিচালনায় অতিরিক্ত সময় ও শক্তি অপচয় হচ্ছে, যন্ত্রের দক্ষতা সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে একই মাঠে একই মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন জাতের ফসল চাষাবাদ হওয়ায় ফসলের জমি তৈরি, রোপণ ও কর্তনের সময়ও ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় উপযুক্ত সময়ে মাঠের মধ্যবর্তী স্থানে প্রয়োজনীয় কৃষিযন্ত্র নেয়া সম্ভব হয় না। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সমবায় ধারণার আদলে বৃহৎ আকারের মাঠে একই শস্য বিন্যাসে চাষাবাদ করা অপরিহার্য। যন্ত্র-উপযোগী মাঠ প্রস্তুত করার জন্য প্রকল্পের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০টি উপজেলায় ৫০ একরের যান্ত্রিক খামার কার্যক্রম চলমান আছে।

যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং গ্রুপের উৎপাদিত পণ্য ও বীজ উপকরণ সংরক্ষণের লক্ষ্যে নির্বাচিত ৩০০টি উপজেলায় ১টি করে উপকরণ সংরক্ষণাগার কাম মেশিন শেড নির্মাণের কাজ চলছে।

দক্ষ মেকানিক-কাম-ড্রাইভার তৈরির উদ্দেশ্যে ১৮টি এটিআই-এ ডরমিটরি ভবন ও প্রশিক্ষণ ভবন নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে।

সরকার ২০২৫, ২০৩০ ও ২০৪১ সালের মধ্যে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে।

প্রকল্প পরিচালক

সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প