কেঁচো সারে রেশমার ভাগ্যবদল

পারভীন লুনা, বগুড়া : বগুড়ায় কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদনে সফল হয়েছেন রেশমা নামের এক কিষানি। তিনি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের বোঙ্গা গ্রামের পরিবার পরিকল্পনা সহকারী হোসনে আরা বেগমের মেয়ে।
রেশমার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার সংগ্রামী জীবনের কথা। অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠেন রেশমা। বয়স যখন দুই মাস, তখন তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং এর পর থেকেই তার বাবা-মায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এরপর মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় রেশমাকে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! পিতৃস্নেহবঞ্চিত রেশমার স্বামীও আর দশজনের মতো ছিলেন না। মাদক ও জুয়া তার নিত্যসঙ্গী। মায়ের কাছ থেকে টাকা আনার জন্য নির্যাতন চালাত রেশমার ওপর। বাধ্য হয়েই স্বামীকে তালাক দিয়ে মায়ের কাছে চলে আসেন রেশমা। এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। নিজ প্রচেষ্টায় পরিশ্রম, ধৈর্য ও সততায় এখন সেই দিন পাল্টেছে। বাড়িতে কেঁচো সার তৈরি করে বিক্রির মাধ্যমে রেশমা নিজেই নিজের সংসারের হাল ধরেছেন। ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন ছাড়াও তিনি তার বাড়ির আশপাশে সুপারি, পেঁপে ও বিভিন্ন শাকসবজির চাষ করছেন। গরু, হাঁস-মুরগি ও কবুতর লালনপালন, পুকুরে মৎস্য চাষ এবং ব্লাক সোলজার পালন করে এখন বদলে গেছে তার সংসার।

রেশমা জানান, শখের বসে ২০১৬ সালে তিনি দুটি গরু পালন শুরু করেন। সেই গরুর গোবর কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই চিন্তা থেকে ২০১৭ সালে মাত্র তিনটি সিমেন্টের রিংয়ে কেঁচো সার উৎপাদনের মাধ্যমে জীবনযুদ্ধের পথচলা শুরু করেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এখন তার খামারে ৬৫টি পাকা চৌবাচ্চা, ১৩৫টি রিং ও ২০০টি ক্যারেটে কেঁচো সার তৈরি হচ্ছে।

উৎপাদিত সার ও কেঁচো বিক্রি করে মাসে প্রায় দুই লাখ টাকার বেশি আয় করেন। বর্তমানে খামারে প্রতি মাসে প্রায় ২০-২২ মেট্রিক টন কেঁচো সার ও ৮-১০ টন ট্রাইকোকম্পোস্ট উৎপাদন হয়। এই প্রকল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে পাঁচ থেকে ২০ নারীর।

রেশমা বলেন, বর্তমানে আমার খামার থেকে উৎপাদিত জৈব সার অনলাইন ও অফলাইন অর্ডারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের কাছে চলে যাচ্ছে। দিন দিন ভার্মিকম্পোস্টের চাহিদাও বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পেলে আমার মতো খামারিরা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারবে।
জানা যায়, তার কেঁচো সার উৎপাদন দেখে প্রথমে এগিয়ে আসে টিএমএসএস। কেজিএফের আওতায় তারা রেশমাকে প্রথমে তার খামার বাড়াতে সহযোগিতা করে। শুরু হয় নতুন করে পথচলা। এরপর তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমি থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন।
রেশমা বলেন, এই সার ব্যবহারে উৎপাদিত ফসল আমি নিজেও খাচ্ছি এবং এলাকার সব কৃষক যাতে ব্যবহার করে, সে বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ কাজে আমি সরকারের পাশাপাশি সর্বসাধারণের সহযোগিতা কামনা করছি। আমি বেকার যুবক ও নারীদের উদ্দেশে বলতে চাই, সততা, ইচ্ছা ও সাহস থাকলে পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সময়ের ব্যপার। আমি অসহায় নারীদের বলছি, আপনারা চেষ্টা করুন। আমরা নারী, আমরাও পারি। আমরা পিছিয়ে থাকব না। আমরা সমাজে অবহেলিত হয়ে নুয়ে পড়ব না।

বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, ‘আমি সুরাইয়া ফারহানা রেশমার কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিজে দেখেছি। রেশমার সংগ্রামী চেষ্টায় শূন্য থেকে সফলতা অর্জন দেশের কিষান-কিষানির জন্য অবশ্যই অনুকরণীয়। যখন দেশের অগণিত কৃষক কৃষিকাজে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করে জমির উর্বরতা নষ্ট করছে, তখন রেশমা জৈব সার তৈরি এবং জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।