পাঠকেরচিঠমানুষ স্বভাবতই আশাবাদী এবং কল্পনাবিলাসী। প্রতিনিয়ত মানুষ অনেক কিছু পাওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষা করে। অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় মানুষের জীবনে অভাব অসীম কিন্তু সেই অভাব পূরণের জন্য সম্পদ সীমিত। সামগ্রিকভাবে অসীম অভাব আর সীমিত সম্পদের দ্বন্দ্ব^ই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব^।
একদিকে যেমন মানুষ আশাবাদী ও কল্পনাবিলাসী আরেকদিকে মানুষ চরমভাবে বাস্তববাদী। বাস্তবতায় থেকে মানুষের কল্পনা করার প্রবৃত্তি চিরন্তন আর বলা হয়ে থাকে মানুষ মূলত কল্পনাতেই সুখী। তবে বাস্তবতার সঙ্গে যখন কল্পনার আকাশ-পাতাল ব্যবধান সৃষ্টি হয় তখনই মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়।
আমাদের জীবনে আমরা সবাই আশা করি একটি উন্নত জীবনের। এই উন্নত জীবন পাওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সম্পদের। কেননা আমরা সবাই একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মধ্য দিয়ে জীবন পরিচালিত করছি। আর এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অর্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের অর্থের প্রয়োজন হয়। যেই ব্যক্তির পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ আছে আপত দৃষ্টিতে আমাদের সমাজে সেই ব্যক্তি তুলনামূলকভাবে ভালো জীবনযাপন করে। অন্যদিকে যার পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ নেই তাকে আমাদের সমাজ অনেকটাই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখ। অর্থের অভাব মানুষের মাঝে হতাশা বা ডিপ্রেশন নামক রোগ সৃষ্টি করে। আর একজন হতাশাতগ্রস্ত ব্যক্তি সারাক্ষণ মানসিক অবসাদে ভোগে।
আমাদের দেশে ডিপ্রেশন নামক ব্যাধিটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিক্ষার্থীর মাঝে। কেননা আমাদের দেশে শিক্ষা অর্জনের মূল লক্ষ্য হলো চাকরি লাভ। স্পষ্ট করে বলতে গেলে অর্থ লাভ। ‘বেশি অর্থে বেশি সুখ’ এই কথাটি কিছু শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষভাবে অস্বীকার করতে চাইলেও পরোক্ষভাবে কিন্তু অস্বীকার করতে পারে না। কেননা আমরা যেই সমাজে বড় হচ্ছি সেই সমাজ, সমাজের লোকজন, আমাদের পরিবার, আমাদের অর্থ নির্ভর চিন্তা করতেই শিখাচ্ছে। বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছে এখন অর্থ। ব্যক্তিজীবনে অর্থের বৃহৎ একটা পরিধি রয়েছে।
বৃহৎ কিছুর প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরকালীন। কিন্তু যদি মানুষ বৃহৎ, বিস্তৃত বিষয়গুলোকে গৌণ রেখে ঠুনকো, ক্ষুদ্র বিষয়গুলো নিয়ে জীবনকে উপভোগ করা একবার শিখে যায়, তবে সেই ব্যক্তির মধ্যে সৃষ্টি হবে জীবনের প্রতি তৃষ্ণা, হাজার বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছে। ভবিষ্যতে অনেক কিছুই ঘটতে পারে এটা ভেবেই মানুষ জীবন থেকে ছুটি নিতে চায়। শরতের তপ্ত দুপুরের হঠাৎ করেই আসা বৃষ্টি দেখে অনেকেরই ভিজতে ইচ্ছে করে। এখন কেউ যদি ঠাণ্ডা লাগবে, জ্বর আসবে এসব ভেবে বৃষ্টিতে না ভিজে তবে তার কাছে জীবন অবশ্যই বিভীষিকাময়। কিন্তু যারা সব সংকটকে ভুলে ক্ষণিকের এক পশলা বৃষ্টিতে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে তারা জীবনকে উপভোগ করছে। ছোট্ট একটি কবিতা পড়ে বন্ধুমহলে প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক নানা কথার সৃষ্টি করে ক্ষানিকটা বিনোদন করার যে প্রচেষ্টা সেটাও কম উপভোগ্য নয়। ছুটির দিনেও একাডেমিক, অফিসিয়াল কাজ করা বাদ দিয়ে প্রভাতের প্রথম আলোয় পরিবারের সঙ্গে বসে এক কাপ চা খাওয়া বিকালে অস্তমিত সূর্যকে দেখার জন্য পরিবার-প্রিয়জনদের সঙ্গে হাঁটাহাঁটি করা, প্রিয়জনদের সঙ্গে বসে হাসিমুখে কথা বলা, ফুটপাতে পায়চারি করতে করতে অল্প টাকার মুখরোচক খাবার খাওয়া, চাঁদের আলোয় বন্ধুরা মিলে বেসুরো গান গাওয়া, একটা মজার বই পড়া এরকম অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ চাইলেই আমরা করতে পারি যেখানে অর্থ অনেক বেশি গৌণ আর সম্প্রীতি ও আন্তরিকতা অনেক বেশি মুখ্য।
অতীতমুখী স্বভাব থেকে বেরিয়ে এসে শুধু ভবিষ্যৎকেই মূল লক্ষ্য না ধরে বর্তমানকে প্রাধান্য দেয়ার মধ্য দিয়েই জীবনকে উপভোগ করা যায়। আর সেটা এই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাতে অর্থকে গৌণ বিষয় হিসেবে রেখেও করা সম্ভব। কাজেই এই যুক্তি এটাই প্রমাণ করে যে শুধু অর্থের অপ্রতুলতাই মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে না! জীবন সম্পর্কে উদাসীনতা, বিষণœœতা, জীবনকে উপভোগ করার প্রতি অনীহাই আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করে। এছাড়া বৃহত্তর আকাক্সক্ষার অপ্রাপ্তি আমাদের মনে হতাশার সৃষ্টি করে আর হতাশা থেকে সৃষ্টি হয় আত্মহননের মানসিকতা।
সর্বোপরি, বলাই বাহুল্য উচ্চাকাক্সক্ষার অপ্রাপ্তি থেকে বেরিয়ে এসে যদি আমরা জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশের সঙ্গে মানিয়ে চলি এবং জীবনকে নিজের জন্য ব্যবহার করি, তবেই জীবনের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ সৃষ্টি হবে বেঁচে থাকার প্রেরণা সৃষ্টি হবে। আমাদের বেঁচে থাকা উচিত ক্ষণিকের এই জীবনের ঠুনকো বিষয়গুলোকে উপভোগ করার জন্য। আর এ জন্য বৃহত্তর বিষয়কে করতে হবে গৌণ আর ঠুনকো বিষয়কে করতে হবে মুখ্য। এই প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যদি কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তবে পরবর্তী সময়ে যেই ফলাফল হবে তা হলো ওই ব্যক্তির পরিবার সাময়িকভাবে হয়তো সংকটে পড়বে, মা-বাবা হয়তো কয়েকদিন কান্না করবে, কয়েকদিন চারপাশের মানুষ শোক প্রকাশ করবে। এতটুকুতেই আত্মহননকারী ব্যক্তির জীবন পরিধি থমকে যাবে। বেঁচে থাকলে আমাদের সমাজ আমাদের নিয়ে উপহাস করে বটে আবার মরে গেলে শোক প্রকাশ করে তাও সেটা দু’এক দিনের জন্য। রহস্যময় এই সমাজ আপনাকে গোলকধাঁধার মধ্যে ধাবিত করবেই কিন্তু আপনি যদি আপনাকে চিনতে পারেন, তবে আপনি সমস্ত গোলকধাঁধা পেরিয়ে বাঁচতে পারবেন এবং সেটা খুব ভালোভাবে। অতএব আমাদের বাঁচতে হবে আমাদের নিজের জন্য।
আলী আহসান
বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়