কেন গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র?

জান্নাতুল ফেরদৌস তামান্না: আব্রাহাম লিংকন ১৮৩৮ সালে লিসিয়াম ভাষণে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যদি পতন হয়, তবে বাইরের কোনো আক্রমণ থেকে নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজনের ফলে হবে। যদি আমাদের অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে যায়, তবে সেগুলোর ধ্বংসকারী যেমন আমরা হব, তেমনি আমাদেরই সেগুলো গড় তুলতে হবে।

দেশের রাজনৈতিক আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতাদের মধ্যে বারবার ভীতি প্রকাশ পায়। গত সেপ্টেম্বরে ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যের ইন্ডিপেনডেন্স হলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি ভাষণ দেন, যেখানে ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তার বক্তব্যের তাৎপর্য বোঝানোর জন্যই তিনি সেখানে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তা লিংকনের ভাষণের মতো ছিল। বাইডেনের ভাষণের শিরোনাম ছিল, জাতির জন্য অব্যাহত যুদ্ধ, যা যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক রাজনীতির মেরুকরণ প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। তাই সেখানে ভালো-মন্দ যা-ই হোক না কেন, তা শুধু সেখানে প্রভাব ফেলে না। এর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্বের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আমরা মানবতার চ্যালেঞ্জগুলো কখনও কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারি না।

১৯৬৫ সালে লিন্ডন বি. জনসন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বর্ণবাদের অবসানের জন্য এবং ভিয়েতনামে আটকে থাকা নাগরিকদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন চলছিল। এতে টালমাটাল হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ছয় দশক পর দেশটি আবার একেবারে ভিন্ন এক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সম্মুখীন হচ্ছে। ষাটের দশকের সামাজিক দ্বন্দ্বগুলো আধুনিক সমাজের জন্য অগ্রহণযোগ্য অবিচারে আবর্তিত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে জনসন বৈধ রাষ্ট্রপতি কি না, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। অথচ বর্তমানে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে এর নির্বাচনী ব্যবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে।

তবে চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য মধ্যবর্তী নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। কারণ সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদের কাছে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখা একটি দল আত্মসমর্পণ করেছে। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের সিনেট ও স্টেট গভর্নরশিপের জন্য রিপাবলিকান প্রাইমারিতে ট্রাম্প যে ২০৮ প্রার্থীকে সমর্থন করেছেন, তাদের ৯৫ শতাংশই ব্যালটে থাকবে। যেখানে কভিড-১৯ মহামারিকেই বিশ্ব এখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি, সেখানে ইউরোপের যুদ্ধ বিশ্বের সমাজ ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। বিশ্বায়নের সুযোগ ও ঝুঁকিগুলো পরিচালনা করার জন্য তৈরি বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভূ-রাজনৈতিক ব্লকগুলোয় বৈশ্বিক বিভাজন এবং এর দুটি প্রধান শক্তির বিভাজন বিষয়গুলোকে আরও খারাপ করে তুলেছে। এই বিভাজিত বিশ্বকে সংকট থেকে বের করে আনার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্ষমতাও ব্যালটে থাকবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ট্রাম্পবাদ যে রাজনৈতিক প্রভাব অর্জন করেছে, তা দেখে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পুরোপুরি স্থায়ী হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচনী পতনের সম্মুখীন হয়ে ক্ষমতা একত্রীকরণে রক্ষণশীলদের সাফল্য ছাড়া ট্রাম্পবাদ কখনও শিকড় গাড়তে পারত না। প্রতিনিধি পরিষদে আলাস্কার আসন পূরণের জন্য বিশেষ নির্বাচনে সাবেক রিপাবলিকান গভর্নর সারাহ পলিনের কাছে ডেমোক্র্যাট মেরি পেলটোলার বিজয়ী হওয়া প্রমাণ করে, ঐতিহ্যগতভাবে লাল রাজ্যেও ট্রাম্প-সদৃশ কর্তৃত্ববাদীদের পরাজিত করা যেতে পারে। এজন্য বাইডেনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে, ডেমোক্র্যাট ও মধ্যপন্থি রিপাবলিকানদের একত্র করা। তবে গণতন্ত্র বাঁচাতে শুধু গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা গড়ে তোলা যথেষ্ট নাও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম শক্তি এর প্রাতিষ্ঠানিক গঠন, যা ফেডারেল সরকারের ক্ষমতাকে নির্বাহী, আইন প্রণয়ন ও বিচারবিভাগীয় শাখায় বিভক্ত করে। ফলে যেকোনো পৃথক শাখার মাধ্যমে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তারপরও রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাম্প্রতিক রায়গুলো সম্পূর্ণ বিচার বিভাগের কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় সুপ্রিম কোর্ট বর্তমানে বৈধতার সংকটে ভুগছেন।

গত আগস্টে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করার জন্য দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাসবিদদের হোয়াইট হাউসে ডেকেছিলেন। রাজনৈতিক মেরুকরণ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে কি না, সেটি পরিষ্কার করাই ছিল তাদের আলোচনার মূল বিষয়।

কোন পর্যায়ে গেলে বিপদ আসবেÑ১৮৩৮ সালে লিংকন এই প্রশ্ন দিয়ে তার লিসিয়াম ভাষণ শুরু করেছিলেন। তিনি এর উত্তরও দিয়েছিলেন, যা এখনও প্রযোজ্য। তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি অভ্যন্তরীণ বিভাজন। লিংকনের এই সতর্কবার্তা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য বর্তমানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।