সোহেল রানা: বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে ডলার সংকট। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আর রপ্তানি আয় নিম্নমুখী ও ধীরগতির ফলে প্রতিনিয়ত কমছে বিদেশি মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ। একজন দরিদ্র কৃষক বৃষ্টিবাদলের দিনে অর্থ উপার্জনে বেরিয়ে পড়ে। তবে চিন্তা নেই গৃহস্থের। কেননা ঘরে আছে চাল, ডাল, তেল, নুন। ঘরে চাল থাকলে ঘোর বর্ষাতেও যেমন গৃহস্থের উদ্বেগের কারণ নেই, বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে ভালো মজুত বা রিজার্ভ থাকলে কোনো দেশের জন্যও সে রকম দুশ্চিন্তার কারণ থাকে না। ভালো রিজার্ভ থাকা সংসারে গোলাভরা চাল থাকার মতো ব্যাপার। এদিকে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দেড় বছর ধরে বিভিন্ন চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতি মাসেই রিজার্ভের পরিমাণ আগের মাসের তুলনায় কমছে। দেশের রিজার্ভ বাড়াতে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, আন্তঃব্যাংক বিনিময় হারে গত সোমবার পাঁচ কোটি ডলার ও মঙ্গলবার দুই কোটি ডলার ইসলামী ব্যাংক থেকে কেনা হয়েছে। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত ডলার থাকলে আমরা তাদের কাছ থেকে তা কিনব। এ ধরনের লেনদেন স্বাভাবিক। আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব ‘গ্রস’ হিসাবে ২০২১ সালের আগস্টে যেখানে রিজার্ভে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, এখন তা ২৫.১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে ২৩ নভেম্বর দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ আছে ১৯.৫২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের কম।
দেড় বছর ধরে চলা ডলার সংকট এখনও কাটেনি। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে গত সেপ্টেম্বরে আমদানি খরচ কমে হয়েছে ৫২৭ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এখনও ঋণপত্র খুলতে চাহিদা মতো ডলার পাচ্ছে না। আবার অনেক উদ্যোক্তাকে ঘোষিত দামের চেয়ে ১২-১৩ টাকা বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
এদিকে গত অক্টোবরে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ১৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৩৭৬ কোটি ডলার।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “বাজারে ডলারের যে অভাব রয়েছে সেটা আংশিক পূরণ করার জন্য প্রতি মাসে একশ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক বিক্রি করছে। এভাবে বিক্রি চলতে থাকলে রিজার্ভ কমতেই থাকবে।”
ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের আমদানি দায় মেটানো যাবে। এটাও ধরে রাখা হয়েছে জোর করে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। ডলারের বাজারকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। তাহলে দাম কিছুটা বেড়ে পরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। তখন রিজার্ভ আবার বাড়বে। তাদের মতে, বৈধ পথে পুরো রেমিট্যান্স দেশে আসছে না। আবার অর্থ পাচার হচ্ছে। পাচারের অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগে সরকার সফল হয়নি, পাচারও ঠেকাতে পারেনি। ফলে অর্থনীতিতে সংকট এখন বহুমুখী। এই সংকট সহসা কাটার সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
১৫ দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ গত ৯ নভেম্বর এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের এখনও ৩ থেকে সাড়ে ৩ মাসের আমদানি বিল মেটানোর সক্ষমতা আছে। তবে গত মাসে রেমিট্যান্স প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এসেছে ১৯৭ কোটি ডলার। এদিকে চলতি মাসের ২৪ দিনে ১৪৯ কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অক্টোবর মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১৯৭ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
এক পরিসংখ্যান তথ্যমতে, বর্তমানে একজন নবজাত জš§ নিলে এক লাখের অধিক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পৃথিবীতে আসে। দেশের ১০ প্রকল্পের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তার জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ ঋণ করে আনা হয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল এক কোটি ৪৪ লাখ ৯২ দশমিক ৯৫ কোটি টাকা। কিছু কালের মধ্যেই ব্যয়ের সেই অঙ্ক প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ৩৫ লাখ ৫৪৩ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা, যা সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, যেভাবে প্রতিমাসেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে, তাতে বড় ধরনের সংকটের দিকে এগোচ্ছে দেশের অর্থনীতি এবং সেটি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। গত এক বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমদানি-রপ্তানির ব্যয় মেটানোর পর প্রতি মাসেই প্রায় একশও কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রিজার্ভের এই পতন ঠেকানোর জন্য নানারকম উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবে খুব বেশি কাজ আসেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের চাপে যদিও সরকার বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়, মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন করা, সুদ ও আমানতের হারে শিথিল করার মতো কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান সময়ের সমস্যা হচ্ছে সরকারের অনেক অপরিশোধিত বিল রয়েছেÑযেগুলো এখনও শোধ করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘এগুলো পুরোটা শোধ করা হলে রিজার্ভ হয়তো অনেক কমে যাবে।’
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের সামনে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বা শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে চাইবে না সরকার। ফলে আগামী কয়েক মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা পরিস্থিতি সামলাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে, তার ওপরেও রিজার্ভের বিষয়টি নির্ভর করবে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘নির্বাচনের পরে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, অর্থনীতির অবস্থা ঠিক করতে হলে, তাদের খুব শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি ধারণা করেন, রিজার্ভ কমলেও সেটা হয়তো দশের নিচে নামাতে দেবে না সরকার। হয়তো অনেক পেমেন্ট আটকে রাখা হবে। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো সংস্থাগুলো থেকে অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করবে সরকার। পাশাপাশি তারা আমদানি বা রপ্তানি নামে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ক্ষেত্রেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি, লুটপাট, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে অর্থ পাচার বাড়ছে। আর এই অবস্থাই রিজার্ভ সংকটের প্রধান কারণ। ডলার সংকটের কারণ প্রসঙ্গে অর্থ পাচার প্রতিরোধ সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়ে কোনো কোনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে।’ তার মানে, এই বাড়তি মূল্যের অর্থ দেশে আনা হয়নি, তা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই অর্থ পাচারের কারণে ডলারের একটি বড় অংশ দেশে আসছে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করছে। তার সঙ্গে আছে সরকারি আমলা ও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির পাচারকৃত অর্থ। যেসব অর্থ দিয়ে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে বেগমপাড়া। সেই তথ্যই দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ করে আসছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান জিএফআই। প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যতটা কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল, তা এখনও নেয়া হয়নি।
একটি জাতীয় দৈনিক এক প্রতিবেদনে বলছে, ‘দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়লেও আমদানি ব্যয় না কমায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ছে। যে কারণে রিজার্ভ বৃদ্ধির বদলে তা কমে যাচ্ছে।’ গত বছর রেমিট্যান্স থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। এই ২ খাত মিলে আয় হয়েছে ৭ হাজার ৩১১ কোটি ডলার। কিন্তু আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। তার মানে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে ৯৩৩ কোটি ডলার।
রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে সরকারÑ আমদানি কমানো, ও রপ্তানি বাড়ানো। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাড়ানো, সেই সঙ্গে আর্থিক হিসাবে বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ানো। আমদানি বাড়লেও রপ্তানির বৃদ্ধি দিয়ে ওকে টেক্কা দেয়া। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেলেও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি দিয়ে ওকে টেক্কা দেয়া। বাণিজ্যিক সেবা খাতের ব্যয় কমিয়ে আনা বা আয় বেশি হারে বাড়ানো।
দেশে যাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা, এসব অনাচার-অনিয়ম-দুর্নীতি-পাচার বন্ধ করার কথা, তারা তা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতাতেই এ কাজগুলো হচ্ছে। যারা অর্থ পাচার বন্ধ ও উদ্ধারের জন্য কাজ করবেন, তারা নিজেরাই যদি এর সহযোগী হন, তাহলে কীভাবে সেই কাজ হবে? তবু আমাদের বিবেকের দায় থেকে, দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে এসব অন্যায়, দুর্নীতি, লুটপাট, পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।
শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়