ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স পিএলসির (ইএলবি) বর্তমান চিত্র দেখে বারবার একটিই প্রশ্ন সামনে আসেÑদেশে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কেন লোকসান কিংবা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে? ইএলবি দেশের একমাত্র সরকারি লুব্রিকেন্টস উৎপাদনকারী কোম্পানি হয়েও দেশের মোট বাজারের এক শতাংশও দখল করতে পারছে না। অথচ তাদের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার মেট্রিক টন, আর দেশের চাহিদা ১ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারেÑসক্ষমতা থাকার পরও কেন এই দৈন্য দশা?
এর একটি বড় কারণ হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে সময়োপযোগী আধুনিকায়নের অভাব। ইএলবি প্রায় ৬৫ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান হলেও এখনো একটি আধুনিক ব্লেন্ডিং প্ল্যান্ট স্থাপন করতে পারেনি। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করলেও কর্তৃপক্ষের গড়িমসি, উদাসীনতা ও প্রশাসনিক জটিলতায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। যখন বেসরকারি কোম্পানিগুলো প্রযুক্তি, বিপণন কৌশল ও গ্রাহকসেবায় প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে, তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চলে গেছে আত্মতুষ্টির গহ্বরে।
অপরদিকে দেখা যাচ্ছে, ইএলবি প্রতি বছর মুনাফা করলেও সেই অর্থ পুনর্বিনিয়োগ না করে রিজার্ভে জমিয়ে রাখা হচ্ছে, যার একটি বড় অংশ ফিক্সড ডিপোজিটে রাখা হচ্ছে সুদের আশায়। অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানির মূলধন বাড়িয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি বিএসইসির নির্দেশনার পরও সেই পথে হাঁটেনি। এতে একদিকে যেমন ব্যবসা প্রসারিত হয়নি, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরাও ন্যায্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এ সমস্যা শুধু ইএলবির একার নয়, দেশের অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই দৃশ্যপট প্রায় একই। অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, জবাবদিহির অভাব, স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং আধুনিক ব্যবসা কৌশলের অনুপস্থিতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিনকে দিন লোকসানি করে তুলছে। ফলে একদিকে সরকারকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো চালাতে হয় ভর্তুকি দিয়ে, অপরদিকে বাজার দখল করে নেয় বেসরকারি খাত, যারা অধিকতর মুনাফা ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই সময় বাস্তবসম্মত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনের। দক্ষ ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিযোগিতায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অন্যথায় জনগণের করের টাকায় চলা এসব প্রতিষ্ঠান কেবলই কাগজে টিকে থাকবে, বাস্তবে নয়।
এ ছাড়া অনেক সময় দেখা যায় রাষ্ট্রের ভেতরে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য কাজ করে। সরকার নিজের প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে সুনজর না দিয়ে বরং বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করে বাজারে প্রতিযোগিতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠানকেই পিছিয়ে দেয়। এটি একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ঘটায়, অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে ন্যায্য বাজার ব্যবস্থাকেও ব্যাহত করে। তাই প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা, যা রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাত উভয়ের জন্যই সমান সুযোগ ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত করবে।