কেবল তালিকা প্রকাশেই সব শেষ নয়

 

‘সংসদে শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ’ শিরোনামে গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি স্বভাবতই অনেক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সেখানে আমাদের প্রতিবেদক জানিয়েছেন, সোমবার আলোচনা শুরুর পর এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় ঋণখেলাপি ১০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তালিকাটি প্রস্তুত হয়েছে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণতথ্য ব্যুরোর (সিআইবি) ডেটাবেজে রক্ষিত ২০১৭ সালের এপ্রিলের মাসভিত্তিক ঋণতথ্যের ভিত্তিতে। সংসদে এভাবে ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ প্রাথমিকভাবে প্রশংসনীয় বলেই বিবেচ্য। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে এ বাস্তবতাও দৃষ্টি এড়ায় না যে, দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। চলতি বাজেটের আকার আমলে নেওয়া হলে খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ মোটেই কম নয়। তবু এ থেকে দ্রুত উপসংহারমূলক কোনো সিদ্ধান্তে আসা সমীচীন হবে না। একে তো অর্থনীতিতে ঋণের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা বিদ্যমান; তদুপরি অর্থমন্ত্রী আমাদের বিস্তারিত জানাননি ওই খেলাপি ঋণের প্রকৃতি কেমনÑতা কী মেয়াদি ঋণ কিংবা খাত অনুপাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কেমন প্রভৃতি। তবু সংসদের মতো স্থানে অর্থমন্ত্রী সংক্ষিপ্তাকারে যে তালিকা প্রকাশ করলেন, তাকে কোনোক্রমেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।

অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তালিকায় হলমার্ক ফ্যাশন লিমিটেডের অবস্থান ১৩তম। আর তালিকার এক নম্বরে রয়েছে দেশে একসময় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকদের মধ্যে শীর্ষে অবস্থানকারী চট্টগ্রামের মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স (প্রা.) লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েক বছর ধরেই দুর্নাম কুড়াচ্ছে এ ব্যাপারে। গত বছর জুলাইয়ের হিসাবেও দেখা যায়, অন্তত ১৫টি ব্যাংকের কাছ থেকে ৮০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে তারা। দুর্ভাগ্য, আলোচ্য তালিকায় রয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চার কোম্পানি, যার মধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটি ঘিরে বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণশিল্প নিয়ে বিপুল প্রত্যাশা ছিল অনেকের। আলোচিত অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে ঋণখেলাপির তালিকায় নাম উঠেছে নূরজাহান সুপার অয়েল, কেয়ার স্পেশালাইজড হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেডের দুটি প্রতিষ্ঠান, আল-আমীন ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট প্রভৃতি। সবার আশা, কেবল এ নাম ঘোষণা করেই ক্ষান্ত দেবেন না অর্থমন্ত্রী। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাও নেবেন। তাকে অবশ্যই ঋণখেলাপিদের জোরালো বার্তা দিতে হবে যে, ব্যাংকঋণ ুফেরত দিতেই হবে গ্রহীতাকে; এ অর্থ আত্মসাৎ করতে পারবে না কেউ। বিশেষত অভ্যাসগত ঋণখেলাপি যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া চাই। খেলাপি মন্দ ঋণ নিয়ে আলোচনা দেশে নতুন। প্রসঙ্গত হলমার্ক বা বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারি প্রভৃতির নাম উঠে আসে স্বভাবতই। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদের ঋণ পেতে ভোগান্তির বিপরীতে বৃহৎ অভ্যাসগত ঋণখেলাপির মন্দ ঋণ অবলোপন কিংবা পুনঃতফসিলীকরণের মতো ঘটনা জনমনে দাগ কেটেছে বলে প্রতীয়মানÑবিশেষত চূড়ান্ত বিচারে ব্যাংকগুলোকে ‘পুনর্ভরণ’ যেখানে করতে হয় তাদের অর্থেই। তাদের কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন যে, বেসরকারি তো বটেইÑজনগণের করের অর্থে পরিচালিত সরকারি ব্যাংকগুলো যেখানে খেলাপিদের ঋণ সরবরাহের প্রাকৃতিক উৎসে পরিণত হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখার দরকার কী? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের গুরুত্ব আমরা অস্বীকার করছি না কিংবা কারও ঢালাও মন্তব্য শুনেই ব্যবস্থা নিতে বলছি না। কিন্তু এসব নিয়ে যে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, সেগুলোর সদুত্তর তো পাওয়া চাই। আর সঠিকভাবে সেগুলোর জবাব দিতে গেলে কেবল তালিকার ঘোষণা দিয়ে বসে থাকা যাবে না, অভ্যাসগত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।