কোথায় থামবে রিজার্ভের পতন!

বিশেষ প্রতিনিধি: স্ফীত রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশের উচ্ছ্বাস বহু আগেই শেষ হয়েছে। পড়ন্ত রিজার্ভ এখন শুধু অর্থনীতিতে ভীতি বাড়াচ্ছে। রেমিট্যান্সের নিন্মমুখী প্রবাহ এ পতনকে আরও বেগবান করেছে। এতে চলতি মাসে ২৬ দিনেই রিজার্ভ কমেছে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এক মাসে এর চেয়ে বেশি রিজার্ভ কমেছিল গত বছর সেপ্টেম্বরে (দুই দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার)। তবে রিজার্ভের পতন শিগগিরই কমার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বরং এ রক্তক্ষরণ আরও চলবে বলেই তাদের মন্তব্য।

সূত্রমতে, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০২১ সালের আগস্টে। করোনাকালীন সময়ে দ্রুত রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, আমদানি হ্রাস ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে যাওয়াই ছিল এর অন্যতম কারণ। সে সময় (আগস্ট শেষে) দেশে গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে ওই সময় নেট রিজার্ভ তথা রিজার্ভ (বিপিএম-৬) ছিল ৪০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

মূলত গত জুন থেকে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে গ্রসের পাশাপাশি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট-৬ বা বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে মোট (গ্রস) রিজার্ভ থেকে ইডিএফ (রপ্তানি বহুমুখীকরণ তহবিল), আইডিএফ (অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল) ও শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশকে দেয়া ঋণ বাদ দিয়ে নেট রিজার্ভের হিসাব করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছর আগস্ট শেষে দেশে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। আর নেট রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০২১ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত দুই বছরে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৮ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার ও নেট রিজার্ভ কমেছে ১৭ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে গত বছর আগস্ট শেষে গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার ও নেট রিজার্ভ ৩০ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে গ্রস ও নেট রিজার্ভ কমেছে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৮১ ও সাত দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে চলতি মাসের ২৬ দিনে গ্রস রিজার্ভ কমেছে দুই দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার ও নেট রিজার্ভ কমেছে দুই দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে প্রতিদিন গড়ে রিজার্ভ কমেছে আট কোটি ডলারের বেশি।

২৬ সেপ্টেম্বর দেশে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় গ্রস ২৭ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার ও নেট ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত কয়েক মাসে শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেশটি সুদসহ পরিশোধ করেছে, যা রিজার্ভের নেট হিসাবে যোগ করা হয়েছে। এছাড়া ইডিএফ ফান্ডের আকারও কমানো হয়েছে। ফলে দুই বছরে গ্রস রিজার্ভের তুলনায় নেট রিজার্ভ কম হ্রাস পেয়েছে।

এরপরও সেপ্টেম্বর শেষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে প্রকৃত রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার রাখার কথা ছিল। তবে রয়েছে তার চেয়ে চার দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার কম। এর আগে জুনে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা ছিল। তবে ওই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল বাংলাদেশের নেট রিজার্ভ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, বর্তমানে যে গ্রস রিজার্ভ রয়েছে, তা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রিজার্ভ কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও কমে হয় ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ দশমিক ০৩ বিলিয়ন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে রিজার্ভ বেড়ে হয় ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। ওই অর্থবছর মোট রিজার্ভ কমে ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক লাফে ১০ বিলিয়ন ডলার কমে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এ সময় সরকারের ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি দায় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। গত অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বেশি বিক্রি করে। তার আগের অর্থবছর সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে। আর চলতি অর্থবছর এখন পর্যন্ত দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করেছে।

জানতে চাইলে পলিসি রির্সাচ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, বর্তমানে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স ভালো অবস্থানে নেই। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি আমদানি করতেই হবে। এতে করে রিজার্ভের আরও রক্তক্ষরণ হবে। তবে নির্বাচনের আগে রিজার্ভ বাড়ানোর তেমন কোনো উপায় নেই।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের পর সরকারের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডলারে আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উৎস খুঁজে বের করতে হবে।

উল্লেখ্য, দেশে গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলারের সংকট শুরু হয়। ফলে ডলারের দাম ৮৮ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ দশমিক ৫০ টাকা হয়েছে। তবে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে ডলার কোথাও মিলছে না। এছাড়া ব্যাংকারদের দাবির মুখে সম্প্রতি বাড়তি দামে ডলারের অগ্রিম মূল্য নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এটি বর্তমান বিনিময় হারের বেশি হবে।