কোম্পানিগুলোয় আটকে আছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও গ্যাস খাতের উন্নয়নে তিনটি তহবিল গঠন করেছে সরকার। গ্রাহকের বিদ্যুৎ বা গ্যাস বিলের একটি অংশ এ তহবিলগুলোতে জমা হওয়ার কথা। তবে এ অর্থ তহবিলগুলোতে নিয়মিত জমা দিচ্ছে না গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো। এতে কোম্পানিগুলোর কাছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা আটকে আছে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সভাপতিত্বে বৈঠকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে জানানো হয়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মূল্যহার আদেশবলে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ), জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল (ইএসএফ) ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল (ইএসডিএফ) গঠিত হয়। তহবিলগুলোতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা জমা পড়ার কথা। তবে জমা পড়েছে ২৮ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় হাজার ৪২৩ কোটি টাকা এখনও কোম্পানিগুলোর কাছে আটকে আছে। এ অর্থ দ্রুত বিইআরসির গঠিত তহবিল তিনটিতে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এদিকে তহবিল তিনটিতে জমা করা অর্থের প্রায় অর্ধেক (১৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা) অব্যবহƒত অবস্থায় পড়ে আছে। বাকি ১৭ হাজার ৮০২ কোটি টাকায় ৩৯টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বলে বৈঠকে জানানো হয়।

তথ্যমতে, ২০০৯ সালের ৩০ জুলাই গ্যাসের মূল্য ১১ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই সময় গঠন করা হয় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ)। সে বছর ১ আগস্ট থেকে এটি কার্যকর করা হয়। তহবিল গঠনের আদেশে কমিশন বলে, ওই দিন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে যে অতিরিক্ত অর্থ পেট্রোবাংলার তহবিলে জমা হওয়ার কথা, তার পুরো অর্থ থাকবে এই তহবিলে। এর থেকে পাওয়া সুদও জমা হবে তহবিলে।

পরবর্তী সময়ে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর সময়ও তহবিলে ইউনিটপ্রতি নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখন এ তহবিলের প্রতি ঘনমিটারে ৪৬ পয়সা জমা রাখা হয়। গত জুন পর্যন্ত তহবিলটির আকার দাঁড়ায় (মুনাফা ব্যতীত) ৯ হাজার ১৯৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এ তহবিল থেকে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আরও আটটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এতে তহবিলটির স্থিতি (মুনাফা ব্যতীত) দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৪১০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

এদিকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বর্তমান সরকার। সে সময় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) উৎপাদন ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাইকারি (বাল্ক) পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যের পাঁচ দশমিক ১৭ শতাংশ অর্থ দিয়ে একটি ফান্ড সৃষ্টির নির্দেশনা দেয় বিইআরসি। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ভোক্তা পর্যায়ে এর বিক্রয়মূল্য সহনীয় রাখার জন্য বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল (ইএসডিএফ) সৃষ্টি করা হয়েছিল।

তহবিলের অর্থে উচ্চ প্রযুক্তির জ্বালানিনির্ভর দক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার শর্ত দিয়েছিল বিইআরসি। গত জুনশেষে এ তহবিলের আকার দাঁড়ায় ৯ হাজার ৬৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকায়।

একইভাবে জ্বালানি নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য ২০১৫ সালে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল গঠন করে বিইআরসি। ওই বছর থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম থেকে এক টাকা এক পয়সা করে এই তহবিলে জমা দেওয়া হয়। এতে প্রতি বছর তহবিলে দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা যোগ হচ্ছে। গত জুনে এ তহবিলের আকার দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭১১ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

বৈঠকে জানানো হয়, ২০১৫ সালে জিডিএফের নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। একই প্রক্রিয়ায় ইএসএফের নিরীক্ষাও সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া অর্থ বিভাগ জিডিএফের পরিশোধিত কর বাবদ দুই হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা কেটে রেখেছে, যা পুনর্ভরণ প্রয়োজন। ওই অর্থ পুনর্ভরণ না হওয়ায় জিডিএফের বকেয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে ইএসএফের অর্থ দিয়ে এলএনজি আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা হচ্ছে। গত জুন পর্যন্ত এ তহবিল থেকে ব্যয় করা হয় ছয় হাজার ৯৯৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বর্তমানে তহবিলটির স্থিতি রয়েছে দুই হাজার ৭১২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

বৈঠকে আরও জানানো হয়, সম্প্রতি এলএনজির ওপর আরও পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করা হয়েছে, যা অব্যাহতির জন্য প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি জিডিএফ ও ইএসএফের মাধ্যমে গৃহীত প্রকল্প বাছাই ও অর্থ ছাড়কারণে বিইআরসির তদারকি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নীতিমালা সংশোধন প্রয়োজন। এছাড়া জিডিএফের মেয়াদ ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি শেষ বলে এর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।

ইএসডিএফ থেকে ৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে বৈঠকে জানানো হয়। গৃহীত প্রকল্পগুলো চলতি বছর মার্চ থেকে উৎপাদনে আসবে বলে জানানো হয়। এছাড়া ইএসডিএফের নিরীক্ষা প্রস্তাব করা হয় বৈঠকে। পাশাপাশি তহবিলে অস্থানান্তরিত দুই হাজার ৫৯২ কোটি টাকা পৃথক হিসেবে স্থানান্তরের প্রস্তাব আসে। আর এ তহবিল থেকে প্রকল্প গ্রহণেও সতর্কতা অবলম্বনের সুপারিশ করা হয়।