কোরবানি, চামড়া শিল্প ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা: মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব ঈদুল আজহা দ্বারপ্রান্তে। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আর এক দিন পরই উদযাপিত হবে দিনটি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দেখানো পথে পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপিত হবে। মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করতে গরিব অসহায় মানুষের প্রতি অন্যদের দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে কোরবানির পশুর মাংস সবার মধ্যে  বণ্টনের বিষয়টিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক দিনে এ সময় আমাদের দেশে অন্ততপক্ষে ৭০-৮০ লাখ পশু কোরবানি হয়। কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এ সময়ের জরুরি একটি কাজ। আমাদের রপ্তানির এক বড় অংশ দখল করে আছে চামড়া শিল্প। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে বিশেষভাবে রাজধানী ঢাকা শহরের জন্য কোরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়টি তাই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধেরর বিষয়টি এ সময়ে অন্যরকম গুরুত্ব পায়। আর এ বছর বিশেষ করে  রাজধানীতে নতুন করে করোনার যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে সবার স্বাস্থ্য সচেতনতায় যথাযথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে কভিডের পাশাপাশি ডেঙ্গুজ্বর থেকে রক্ষা পেয়ে সবাই মিলে এ সময়টি পার করা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।  

রাজধানীতে এ বছর ঢাকা দক্ষিণ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ১৯টি স্থানে গরুর হাট পরিচালিত হবে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরের অধীনে গাবতলী গরুর হাট এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে সারুলিয়া গরুর হাট পরিচালিত হয়ে আসছে স্থায়ীভাবে, যেখানে বছরের অন্যান্য সময়ও পশু কেনাবেচা হয়। এছাড়া এ বছর ঢাকা দক্ষিণে কোরবানি উপলক্ষে ১০টি এবং ঢাকা উত্তরে ৭টি অস্থায়ী গরুর হাট পরিচালিত হচ্ছে। এরকম একটা সময়ে কোরবানির পশুর বর্জ্য যেন অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতির জন্ম দিতে না পারে সেদিকে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ জাগরিত হবেÑএ বিশ্বাস সবার। প্রতি বছরের ন্যায় সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে কোরবানির জন্য স্থান নির্দিষ্ট করলেও তা সঠিকভাবে প্রতিপালিত হয় না। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের এবার বিশেষভাবে উদ্যোগ গ্রহণ ব্যতিরেকে বিকল্প নেই। পাশাপাশি চামড়া শিল্প আমাদের রপ্তানি বাজারকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেটি যেন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ আমাদের চামড়া সংরক্ষণ,  প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির জন্য এ সময়টিই বছরের একমাত্র সময়।  

জবাইকৃত বিপুল পরিমাণ কোরবানির পশুর বর্জ্য, রক্ত, নাড়িভুঁড়ি, হাড়, ছুটছাট মাংস-চর্বি,  খুর, শিং প্রভৃতি  উচ্ছিষ্ট অংশ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ঈদের দিন এবং তার পরের দিন সাধারণত পশু কোরবানি হয়। রাজধানীতে নির্দিষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও যত্রতত্র  কোরবানি করে পরিবেশ নোংরা করে জনস্বাস্থ্যের হুমকি যেন কোনোক্রমেই না হতে পারে সেদিকে সিটি করপোরেশনসহ সবার দায়িত্ব রয়েছে। কোরবানি শেষ হওয়া মাত্রই সিটি করপোরেশনকে যথেষ্ট জনবল নিয়ে বর্জ্য অপসারণে লেগে পড়তে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব এ বর্জ্য অপসারণ করতে হবে।

কোরবানির পশুটি যেন রোগমুক্ত ও উপযুক্ত হয়,  কোরবানির পূর্বে পশুটিকে গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ও কোরবানির জন্য নির্ধারিত জায়গাটি  ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে। পশুর চামড়া ছাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তি দ্বারা ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে পশু কোরবানি ও চামড়া যাতে কোনোভাবেই নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চামড়া কেটে ছিঁড়ে গেলে রপ্তানি যেমন বাধাগ্রস্ত হবে তেমনি সঠিক মূল্য ও পাওয়া সম্ভব হবে না। আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের পরই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চামড়াশিল্পের অবস্থান। বাংলাদেশ ২০১৪ সালে ২৬০ মিলিয়ন বর্গফুট ফিনিশড লেদার রপ্তানি করেছে, যদিও এ সময় উৎপাদিত ফিনিশড লেদারের পরিমাণ ছিল ২৮০ মিলিয়ন বর্গফুট। অথচ একটু পেছনে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশ কাঁচা চামড়া বা ‘ওয়েট ব্লু লেদার’ এবং ‘ক্রাস্ট লেদার’ বা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি করত। সময়ের ব্যবধানে চামড়া শিল্পের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এখন ট্যানারি মালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় বাজার হলোÑইতালি, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, স্পেন, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ানসহ বেশ কয়েকটি দেশ। বিকাশমান শিল্পের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে চামড়া শিল্প অন্যতম। এ শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল যদিও গত দুই বছরে এ খাতের অবস্থা বিভিন্ন কারণে মোটেই ভালো নয়, সুতরাং আমাদের এ গুরুত্ব অনুধাবন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।                                                                                                                                                                                                                                                            

যেখানে-সেখানে গরুর হাট বসিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত ও নোংরা পরিবেশ যাতে কেউ সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য সিটি করপোরেশন গরুর হাটের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করেছে। পরিবেশসম্মত কোরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০১৫ সালের  কোরবানির ঈদে ঢাকা মহানগরীর ৩৯৩টি, ২০১৬ সালে ঢাকা দক্ষিণে ৫৮৩টি এবং উত্তরে ৫৬৭টি এবং ২০১৭ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৬২৫টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৪৯টি স্থানকে  কোরবানি করার জন্য স্থান নির্ধারিত করে দেয়।  পরবর্তী সময়ে এ বছর রাজধানীতে প্রয়োজন মতো এর সম্প্রসারণ করা হয়েছে যেন কোনো রকম যানজট  বা পরিবেশের জন্য প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি না করে। আশা করা যায়, এ বছর রাজধানীতে এ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে এবং রাজধানীবাসী নতুন করে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুজর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। যথাযথভাবে কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্ভব হলে পরিবেশ বিপর্যয় রোধের পাশাপাশি সব জবাইকৃত পশুর উচ্ছিষ্ট সম্পদে রূপান্তরের করা সম্ভব হবে। নিশ্চয়ই সার্বিক বিবেচনায় আমরা যার যার অবস্থান থেকে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সবাই সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসব, পরিবেশ ও পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি করোনা ও ডেঙ্গুজর প্রকোপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সচেষ্ট হবো।  

মুক্ত লেখক

asm.19musa@gmail.com