মো. ইমরান হোসেন: শেষ হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলোকে হারিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ঘরে তুলেছে ক্রিকেটের জন্মদাতা ইংল্যান্ড। এক মাসের বেশি সময় ধরে হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ক্রিকেট মানুষের হৃদয়ে আঘাত করে; কখনও আনন্দ দিয়ে থাকে, আবার কখনও চোখের পানিও ঝরায়। তবে বাংলাদেশে এখন ক্রিকেটের নামে চলছে সর্বনাশা জুয়া।
প্রশ্ন উঠবে কীভাবে চলছে এই জুয়া? এক ঘটনা বলি। গত ২ জুন ছিল বাংলাদেশ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা। ঈদুল ফিতরের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি ছিলাম। বন্ধুরা একসঙ্গে স্কুলমাঠে আড্ডা দিচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে খেলার স্কোর দেখছি মাঠের পাশে চায়ের দোকান থেকে। চায়ের দোকানে ছোট থেকে বড় সব স্তরের মানুষের ভিড়। বাংলাদেশের খেলা বলে কথা। খেলার মাঝামাঝি সময় দেখলাম, চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে আমার পরিচিত একজন মাঠের অন্যপ্রান্তে নির্জনে সিগারেট খাচ্ছেন। তাকে বিষণœ মনে হলো। কাছে গিয়ে দেখলাম কাঁদো কাঁদো ভাব। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন। বললেন, মায়ের ডিপিএস ভেঙে টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে দোকানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলাম। হঠাৎ করে বাজি ধরে হারতে হারতে আমার সব টাকা হেরে গেছি। এখন বাড়িতে গিয়ে কী উত্তর দেব? আমার মধ্যে কৌতূহল জাগল কীভাবে ক্রিকেট নিয়ে জুয়া বা বাজি ধরা হয়?
মলিন মুখেই শোনালো সেই কথা। তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, তারা খেলা শুরুর আগে কয় উইকেটে কোন দল জিতবে, কোন খেলোয়াড়ের কত ওভার মেডেন হবে, কত ওভারে কত রান হবে, কোন খেলোয়াড় হাফ সেঞ্চুরি বা সেঞ্চুরি করবে এসব বিষয়ে বাজি ধরা হয়। অনেক সময় বলে বলেও বাজি ধরা হয়। আর বাজির টাকা নগদে পরিশোধ করতে হয় সঙ্গে সঙ্গে। টাকা না থাকলে সুদে ঋণ দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। সেও নাকি বিপিএলে এই জুয়া খেলে ৩০ হাজার টাকার ওপরে লাভ করেছে। শুনেই আমার চোখ কপালে উঠল।
এবার কৌতূহল আরও বাড়তে থাকল, গেলাম চায়ের দোকানদার সালাম (ছদ্মনাম) সাহেবের কাছে। তিনি জানান, দিন শেষে তার রোজগার ৭০০ বা তার কিছু বেশি। কিন্তু যেদিন কোনো দলের ক্রিকেট খেলা থাকে, সেদিন তার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সেদিন দুই থেকে তিন হাজার টাকাও নাকি বেচাকেনা হয়। দোকানের সামনে রাখা লম্বা টুলে খেলা শুরু হলেই ভিড় জমায় স্থানীয় কিছু মানুষ।
সালাম সাহেবের দোকানের সামনে ভিড় করে তরুণ, ছাত্র কিংবা মাঝবয়সি ব্যবসায়ীসহ যারা আছেন, সবাই টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখেন আর বাজি ধরেন। তাদের বাজি টাকার অঙ্কে খুব বড় নয়। কিন্তু নেশাটা ভয়ংকর। তাদের অনেকেই এরই মধ্যে সর্বস্ব খুইয়েছেন, কিন্তু এটা নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং নানা কায়দায় অর্থ সংগ্রহ করে প্রতিদিন ক্রিকেট বাজির নামে জুয়া খেলায় মেতে ওঠেন তারা।
এবার বলি ঢাকা শহরের একটি গল্প। বাড়ি থেকে এসেই সেদিন গিয়েছি সেলুনে চুল কাটাতে। দেখি সেলুনে প্রচুর ভিড়। প্রথমে ভেবেছিলাম সবাই তাদের কাস্টমার, পরে দেখি তা নয়। তারা খেলা দেখছে আর বাজি বাঁধছে, যা আমাদের কাছে জুয়া নামেই পরিচিত। বেশিরভাগ লোক দৈনিক কাজ করে উপার্জন করে। ছাত্ররাও রয়েছে।
শুধু সালামের দোকান বা সেলুন নয় ক্লাবে, পাড়ায়, মহল্লায়, অফিসে, বাসায় ও চায়ের দোকানে এই ক্রিকেট জুয়া এখন চলছে বেপরোয়াভাবে। জুয়াড়িরা ওড়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এমন ক্রিকেট জুয়া মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। ক্রিকেট জুয়ার ছড়াছড়ি সমাজের অভিজাত ও শিক্ষিত শ্রেণি ছাড়িয়ে তরকারি বিক্রেতা, নাপিত, হোটেল কর্মচারী, রিকশাচালক, দোকানি, বেকার, ফল বিক্রেতা, বিভিন্ন পরিবহনের শ্রমিক (হেলপার ও কন্ডাক্টর) নির্মাণ শ্রমিকসহ বিভিন্ন নিম্ন পেশার মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে; বাদ পড়ছে না স্কুল-কলেজগামী কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও। কোনো কোনো অফিসেও নাকি সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে বাজি ধরছেন। ক্রিকেট জুয়ায় টাকা-পয়সা খুইয়ে আত্মহত্যার মর্মান্তিক খবরও শুনতে হচ্ছে কখনও কখনও। ক্রিকেট জুয়ার ফাঁদে পড়ে আবার কেউবা দিচ্ছে কপালে হাত। অনেকে একে জুয়া না বলে বলছেন বাজি ধরা।
কেবল স্থানীয় পর্যায়েই নয়, ইন্টারনেটে ক্রিকেট জুয়ার ফাঁদ পেতে আছে বহু ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ। ঢাকার এক তরুণ চাকরিজীবী বলেন, তিনি চার-পাঁচ বছর ধরে ক্রিকেটের বিভিন্ন আয়োজনে বাজি ধরে আসছেন। একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তিনি বাজি ধরেন।
বাংলাদেশ বা বিশ্বে যেকোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হলেই এই জুয়া শুরু হয়। দিন দিন এই জুয়ায় প্রবণতা বেড়েই চলেছে। আর এই জুয়া দলগত ও ব্যক্তিপর্যায়েও হয়। টিভির সামনে দলে দলে ভাগ হয়ে জুয়াড়িরা ক্রিকেট জুয়া খেলে। জানা যায় ম্যাচভেদে ন্যূনতম তিন হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাজি ধরা হয়। সারা দেশে প্রধানত ব্যবসায়ীরা এর প্রতি বেশি আসক্ত।
অনেকে বলছেন, কিছু ক্রিকেট জুয়াড়ি জুয়ার টাকা জোগাতে গিয়ে চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে ক্রিকেট জুয়ার হারজিতকে কেন্দ্র করে পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। বিগত বছরগুলোর পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম, আইপিএল, বিপিএল, পিএসএল, বিগব্যাশ ও ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলায় মহল্লার চায়ের দোকানগুলোতে প্রচুর ভিড় জমে। অনেক সময় লেনদেনে ব্যাঘাত ঘটে দু’পক্ষের মধ্যেও হাতাহাতি লেগে যায়। এই জুয়া খেলা নিয়ে রাজধানীর মধ্যবাড্ডায় ছুরিকাঘাতে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসিম আহমেদকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত নাসিম আহমেদ মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। বিপিএল নিয়ে ক্রিকেট জুয়ার জেরে তাকে নাকি হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন নাসিমের ভাই ইফতেখার আহমেদ ফয়জুদ্দিন।
জুয়া সামাজিক শান্তি বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে যেহেতু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে গেছে, তাই এই সামাজিক ব্যাধি বন্ধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা আমাদেরই নিতে হবে। বিশেষ করে ব্যস্ত বাজার ও পাড়া-মহল্লায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়ে দিলে এই নেতিবাচক কাজ থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে। দেরি হয়ে গেলে এর প্রভাব পড়বে সর্বত্র। সমাজে বড় ধরনের কোনো সর্বনাশ হওয়ার আগেই লাগাম টেনে ধরতে হবে। বন্ধ করতে হবে এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিষয়টি নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেই মঙ্গল। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাও তা-ই।
জুয়ার প্রতিরোধে এখনই দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে ছাত্র-যুবকেরা তো বটেই, কিশোররা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যাবে বলে শঙ্কিত বিশিষ্টজনেরা। আমি মনে করি, সরকারের উচিত জুয়ার বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে ওঠা। বিটিআরসির মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি পুলিশ ও গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে তৎপর করে তোলা গেলে ‘ভার্চুয়াল’ জগতের ওয়েবসাইটগুলোকে শুধু নয়, অন্তরালের আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদেরও চিহ্নিত করা সম্ভব। একই সঙ্গে সম্ভব বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে তৎপর সব জুয়াড়িকেও গ্রেফতার করা। সরকারের কাছে এমন কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই। আমরা চাই, ক্রিকেট শুধু বিনোদনমূলক ক্রীড়া হিসেবেই এগিয়ে যাক, জনপ্রিয় হয়ে উঠুক। এর সঙ্গে যেন কোনোক্রমেই জুয়ার মতো অপরাধ যুক্ত হতে না পারে।
গণমাধ্যমকর্মী
imran3994@gmail.com