একসময় ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা বলতেই আমাদের চোখে ভেসে উঠত প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক সংগ্রামী নারীর ছবি, যার পুঁজি বলতে ছিল কেবল তার অদম্য ইচ্ছা আর ক্ষুদ্রঋণের কিস্তির টাকা। তথ্যপ্রযুক্তি আর আধুনিক যোগাযোগের সুযোগ ছিল তার নাগালের বাইরে। বাজারদর জানা, সরকারি কোনো সুবিধা সম্পর্কে খবর রাখা অথবা জরুরি স্বাস্থ্য পরামর্শের জন্য তাকে প্রায়ই অন্যের ওপর নির্ভর করতে হতো অথবা দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হতো। আর্থিক লেনদেন ছিল সম্পূর্ণ নগদনির্ভর, যা বহন করত নানা ঝুঁকি এবং সময় অপচয়। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে স্মার্টফোন সেই চিত্রটিকেই বদলে দিতে শুরু করেছে। এই ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা নারীদের হাতে হাতে এখন শোভা পাচ্ছে স্মার্টফোন, যা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, হয়ে উঠেছে তাদের জীবনমানের উন্নয়নে এক শক্তিশালী হাতিয়ার। এই ছোট্ট যন্ত্রটি তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে সামাজিক অবস্থান পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে।
স্মার্টফোনের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং দৃশ্যমান প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হলো তথ্যের অবাধ প্রবাহ। ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা নারীরা অধিকাংশই ছোটখাটো ব্যবসা বা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন। আগে বাজারদর জানার জন্য বা তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণের জন্য দালালদের ওপর নির্ভর করতে হতো অথবা দূরবর্তী বাজারে গিয়ে খোঁজ নিতে হতো। স্মার্টফোন হাতে আসার পর তারা এখন সহজেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে যেকোনো পণ্যের দৈনিক বাজার মূল্য জানতে পারছেন। যেমন- একজন সবজি বিক্রেতা নারী তার ফোন ব্যবহার করে পাশের শহরের পাইকারি বাজারের দর দেখে তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন, যা আগে সম্ভব ছিল না। একইভাবে, কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত নারীরা আবহাওয়ার পূর্বাভাস, উন্নত জাতের বীজ বা সারের তথ্য, রোগবালাই প্রতিরোধের উপায় ইত্যাদি বিষয়ে কৃষি বিভাগের ওয়েবসাইট বা অ্যাপ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারছেন। এই তথ্যের সহজলভ্যতা তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং লোকসান কমাতে সরাসরি সহায়তা করছে।
এ তথ্য কেবল জানার জন্যই নয়, সরাসরি তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডেও সহায়তা করছে। অনেক নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের তৈরি পণ্য বা কৃষিজাত পণ্য বিক্রি করার জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন। একজন নকশিকাঁথা বা হস্তশিল্প বিক্রেতা নারী হয়তো তার পণ্যের ছবি তুলে ফেসবুক বা অন্যান্য গ্রুপে পোস্ট করছেন এবং সরাসরি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়ানো যাচ্ছে, তেমনি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাচ্ছে এবং বাজারের পরিধিও বিস্তৃত হচ্ছে। আগে যেখানে কেবল স্থানীয় বাজারেই পণ্য বিক্রি সীমাবদ্ধ ছিল, এখন দেশের অন্য প্রান্তের ক্রেতাদের কাছেও পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। এটি তাদের ব্যবসার আকার বৃদ্ধি এবং আয় বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন নারী যিনি বাড়িতে আচার তৈরি করেন, তিনি তার স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনলাইনে তার পণ্যের প্রচার করে নতুন গ্রাহক তৈরি করতে পারছেন, যা তার আয়কে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও স্মার্টফোন বিপ্লব এনেছে। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে তারা এখন সহজেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে, যা আগে অনেক সময় ও অর্থের অপচয় করত। ঋণের কিস্তি দেয়ার জন্য হয়তো সপ্তাহে একদিন নির্ধারিত স্থানে যেতে হতো, যার ফলে সেই দিনের কাজ বন্ধ রাখতে হতো এবং যাতায়াত খরচও লাগত। এখন ঘরে বসেই মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে তারা এ কাজটি সম্পন্ন করতে পারছে। শুধু কিস্তি পরিশোধই নয়, তারা এখন বিভিন্ন সরকারি ভাতা বা অনুদান সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে গ্রহণ করতে পারছে। জরুরি প্রয়োজনে টাকা পাঠানো বা গ্রহণ করাও অনেক সহজ হয়েছে। এই ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে আরও নিরাপদ এবং কার্যকর করে তুলেছে। একজন ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা নারী যিনি দূরে কাজ করতে যাওয়া তার স্বামীর কাছ থেকে টাকা পেতেন, এখন তিনি সহজেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেই টাকা গ্রহণ করতে পারেন, যা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।
যোগাযোগ সহজ হওয়ায় তাদের সামাজিক ও ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কও শক্তিশালী হচ্ছে। তারা অন্যান্য উদ্যোক্তাদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারছে, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারছে এবং একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারছে। বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপ বা ফোরামের মাধ্যমে তারা সমমনা নারীদের সাথে যুক্ত হয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, যা তাদের মধ্যে এক ধরনের সংহতি তৈরি করছে। তাছাড়া পরিবারের সদস্যদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা সম্ভব হওয়ায় তাদের মানসিক শান্তিও বাড়ছে। বিশেষ করে যারা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যান, তারা নিয়মিত পরিবারের খোঁজখবর রাখতে পারছেন।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যের অভাব বা জরুরি অবস্থায় প্রাথমিক পরামর্শের জন্য তারা এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারে। অনেক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হয় না। স্মার্টফোন ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট বা অ্যাপ থেকে তথ্য জানতে পারছেন। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরামর্শও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। শিশুদের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য বা শিক্ষামূলক অ্যাপ ব্যবহার করতে পারছে, যা গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখছে। লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে যখন স্কুল বন্ধ ছিল, তখন অনেক শিশুই স্মার্টফোনের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পেরেছে বা পড়াশোনার উপকরণ পেয়েছে, যা তাদের শিক্ষাজীবনকে সচল রাখতে সাহায্য করেছে। মায়ের হাতে থাকা স্মার্টফোন অনেক সময় সন্তানের শিক্ষার উপকরণ হিসেবেও ব্যবহƒত হচ্ছে।
সময় এবং আর্থিক সাশ্রয়ের দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজার বা ব্যাংক যাওয়ার জন্য দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়ার প্রয়োজন কমেছে, যা তাদের মূল্যবান কর্মঘণ্টা বাঁচিয়ে দিচ্ছে। এই সাশ্রয় হওয়া সময় তারা তাদের ব্যবসা বা পরিবারের পেছনে ব্যয় করতে পারছেন। দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে সরাসরি লেনদেন করতে পারায় আর্থিক স্বচ্ছতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন পরিষেবার বিল পরিশোধ-যেমন বিদ্যুৎ বা গ্যাস বিল, এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে করা সম্ভব হচ্ছে, যা তাদের জীবনকে আরও সহজ করে তুলছে।
তথ্য ও প্রযুক্তির এই সংস্পর্শ তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি করছে। পরিবার এবং সমাজে তাদের কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হচ্ছে। তারা এখন অনেক বিষয়ে নিজস্ব মতামত দিতে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে আরও সক্ষম। প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, যা তাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াচ্ছে এবং সমাজের মূল স্রোতের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। আগে যারা কেবল গৃহস্থালি কাজ বা ক্ষুদ্র ব্যবসার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন, স্মার্টফোন তাদের সামনে খুলে দিয়েছে জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার। এটি তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং ক্ষমতায়নে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একজন নারী যিনি আগে বাড়ির বাইরে খুব একটা যেতেন না, এখন তিনি স্মার্টফোন ব্যবহার করে বাইরের দুনিয়ার খবর রাখছেন, যা তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছে।
তবে এই চিত্রটির অন্য দিকও রয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহার এখনও সবার জন্য সহজলভ্য নয়। দাম, ডেটা খরচ এবং নেটওয়ার্কের দুর্বলতা অনেক ক্ষেত্রেই একটি বড় বাধা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়া একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তাছাড়া ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব একটি প্রধান সমস্যা। অনেক নারীর স্মার্টফোন থাকলেও এটি কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই। ফিশিং বা অনলাইন জালিয়াতির মতো নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কেও তাদের সচেতনতার অভাব থাকতে পারে। স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার বা তথ্যের অপব্যবহারের মতো সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোও বিদ্যমান। তাই কেবল স্মার্টফোন হাতে তুলে দিলেই হবে না, এর সঠিক ব্যবহার এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমও জরুরি।
সব মিলিয়ে বলা যায়, স্মার্টফোন ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা নারীদের জীবনে কেবল আর্থিক লেনদেনের সুবিধা আনেনি, এনেছে তথ্য, জ্ঞান এবং যোগাযোগের এক বিশাল সুযোগ। এটি তাদের ক্ষমতায়ন, জীবনমানের উন্নয়ন এবং সমাজের মূল স্রোতের সাথে যুক্ত হওয়ার এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহার করে তারা যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, তেমনি সামাজিকভাবেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে যদি ডিজিটাল বিভেদ কমিয়ে আনা যায় এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা যায়, তবে স্মার্টফোন হতে পারে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা নারীদের জীবন পরিবর্তনে এক শক্তিশালী অনুঘটক, যা দারিদ্র্য বিমোচন এবং নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই প্রযুক্তি একদিকে যেমন তাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, তেমনি তাদের মধ্যে নতুন সম্ভাবনা ও স্বপ্নের বীজ বুনে দিচ্ছে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী