ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় প্রধান উপদেষ্টার ভাবনা ও বাস্তবতা

ড. মতিউর রহমান : দারিদ্র্য মানব সমাজের এক অভিশাপ এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণ চলছে। এই অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় ক্ষুদ্রঋণ এক শক্তিশালী এবং কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছে, যা প্রান্তিক এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের প্রবর্তন এবং এর ব্যতিক্রমী সাফল্য বিশ্বব্যাপী এক মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম কেবল কিছু নির্বাচিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ক্ষুদ্র পরিসরের কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে একটি বিশাল, সুসংগঠিত এবং প্রভাবশালী আর্থিক খাতে রূপান্তরিত হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে।

এই বিবর্তনের একটি ক্রান্তিলগ্নে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণকে ভবিষ্যৎ ব্যাংকিংয়ের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে এক দূরদর্শী মন্তব্য করেন। তার এই বিশ্লেষণ ক্ষুদ্রঋণ খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে এর সম্পর্ক ও অবস্থান নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনার উদ্রেক করে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটির (এমআরএ) নতুন ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দেয়া তার এই তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণটি ক্ষুদ্রঋণ খাতের ধারণা, প্রধান উপদেষ্টার উচ্চাকাক্সক্ষী ভাবনা এবং বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে এক মেলবন্ধন তৈরি করে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বক্তব্যে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা এবং ক্ষুদ্রঋণের অন্তর্নিহিত শক্তিকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, মাইক্রোক্রেডিট কেবল একটি আর্থিক লেনদেন পদ্ধতি নয়, বরং এটি ব্যাংকিংয়ের এক নবতর এবং উন্নত সংস্করণ, যা ভবিষ্যতের পথ দেখায়। তিনি প্রচলিত ব্যাংকিং ধারণার মূলে নিহিত সমস্যাটি চিহ্নিত করেন। তার মতে, ‘ব্যাংক’ শব্দটি ইংরেজি ‘ট্রাস্ট’ বা বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে প্রচলিত ব্যাংকগুলো মূলত জামানত বা কোলাটারালের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়।

এই জামানতের ওপর নির্ভরতা এক অর্থে অবিশ্বাসকেই প্রতিফলিত করে, যেখানে গ্রাহকের নিজস্ব সক্ষমতা বা বিশ্বাসের চেয়ে তার সম্পত্তির মূল্যকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এর বিপরীতে, গ্রামীণ ব্যাংক এবং অন্যান্য সফল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস, সততা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এখানে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে জামানত নয়, বরং ব্যক্তির সম্ভাবনা এবং তার কাজের প্রতি অঙ্গীকারই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে কাজ করে। ড. ইউনূস দৃঢ়ভাবে বলেন যে, প্রচলিত জামানতভিত্তিক ব্যাংকগুলো যেখানে আর্থিক অনিয়ম, খেলাপি ঋণ এবং অর্থ লোপাটের মতো গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়ে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে, সেখানে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ আদায় পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অত্যন্ত ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরে।

ক্ষুদ্রঋণের ঋণগ্রহীতারা সাধারণত অর্থ নিয়ে পালিয়ে যায় না; তারা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করে, যা এই ব্যবস্থার মৌলিক শক্তি এবং বিশ্বাসের ভিত্তিকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। এই বাস্তব এবং শক্তিশালী ভিত্তিকে সামনে রেখেই ড. ইউনূস ঘোষণা করেন যে, মাইক্রো ক্রেডিটই হলো প্রকৃত ব্যাংকিং এবং এটিই আগামী দিনের ব্যাংকিংয়ের মূল ভিত্তি তৈরি করবে। তিনি বিশ্বাস করেন যে ভবিষ্যতের ব্যাংকিং পরিচালিত হবে মানুষের নিজের পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে, তার বিশ্বাসের জোরে এবং তার কাজের সক্ষমতার ওপর, কেবল টাকার জোরে নয়। এটি প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের কাঠামোগত ত্রুটি এবং নৈতিক দুর্বলতার বিপরীতে ক্ষুদ্রঋণের নৈতিক দৃঢ়তা, কার্যকরী সাফল্য এবং সামাজিক মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরে, যা এটিকে ভবিষ্যতের জন্য আরও উপযুক্ত করে তোলে।

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণকে কেবল এনজিও পরিচয়ে আবদ্ধ না রেখে এটিকে ব্যাংকিংয়ের ধারণা আত্মস্থ করানো এবং একটি প্রকৃত ব্যাংকে রূপান্তরিত করা। তিনি মনে করেন যে ক্ষুদ্রঋণকে তার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে হলে কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি মানসিকতার পরিবর্তনও প্রয়োজন। তার ভাষায়, এনজিও পর্যায়ে থেকে গেলে ব্যাংকিং মেজাজ আসবে না। মেজাজে আসতে হলে এটাকে ব্যাংক হতে হবে।”এই ব্যাংকিং মেজাজ বলতে তিনি সম্ভবত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে আরও উন্নত পেশাদারিত্ব, বৃহত্তর আর্থিক শৃঙ্খলা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আধুনিক পদ্ধতি এবং পুঁজির দক্ষ ব্যবহারকে বোঝান।

এটি এমন একটি পরিবর্তন যা ক্ষুদ্রঋণের সামাজিক মিশন এবং মানবিক দর্শনকে বজায় রাখবে, কিন্তু একই সঙ্গে এটি একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল এবং বিস্তৃত আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করবে, যা এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। তার ভাবনা হলো, ক্ষুদ্রঋণ তার মৌলিক নীতি, অর্থাৎ জামানতবিহীন ঋণ এবং বিশ্বাসভিত্তিক সম্পর্ককে অক্ষুণ্ন রাখবে, তবে একই সঙ্গে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের মতো আমানত সংগ্রহ, অন্যান্য আর্থিক সেবা প্রদান এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আর্থিক জীবনে আরও গভীরভাবে সংযুক্ত হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে। এই রূপান্তর প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের পরিধিকে প্রান্তিক মানুষের কাছে প্রসারিত করবে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য অর্জনে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক মাইক্রোক্রেডিটের জন্য একটি আলাদা এবং স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের আহ্বান ছিল তার ভাবনার একটি অপরিহার্য অংশ। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে ক্ষুদ্রঋণের বিশেষ প্রকৃতি এটিকে প্রচলিত ব্যাংক আইনের অধীনে পরিচালনার জন্য সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত করে তোলে। তিনি একটি সরল এবং কার্যকর উপমা ব্যবহার করে এই বিষয়টি স্পষ্ট করেন: আমেরিকান ফুটবল এবং ইউরোপিয়ান ফুটবল উভয়ই ‘ফুটবল’ খেলা হলেও তাদের নিয়মকানুন এবং খেলার ধরন মৌলিকভাবে ভিন্ন। ঠিক একইভাবে, গ্রামীণ ব্যাংক এবং অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংক উভয়েই ‘ব্যাংক’ হিসেবে পরিচিত হলেও তাদের পরিচালনার নীতি, পদ্ধতি এবং লক্ষ্য মৌলিকভাবে আলাদা। প্রচলিত ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রকরা সাধারণত বৃহৎ মূলধন সুরক্ষা, জামানতের নিশ্চয়তা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দৃষ্টিকোণ থেকে বিধিমালা প্রণয়ন করেন।
এই বিধিমালাগুলো ক্ষুদ্রঋণের ক্ষুদ্র ঋণের পরিমাণ, ব্যক্তিগত পর্যায়ের নিবিড় সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধন এবং অতি দরিদ্র মানুষের আয়-ব্যয়ের অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় বিশেষায়িত পদ্ধতির জন্য ডিজাইন করা হয়নি। যদি প্রচলিত ব্যাংক আইনের কঠোর এবং অনমনীয় কাঠামো ক্ষুদ্রঋণ খাতের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে এর নমনীয়তা, প্রান্তিক মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর সক্ষমতা এবং এর সামাজিক লক্ষ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে, এমনকি এর অস্তিত্বও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এই কারণেই একটি আলাদা, উপযোগী এবং নমনীয় আইনি কাঠামো প্রয়োজন, যা ক্ষুদ্রঋণের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোকে স্বীকৃতি দেবে, এর কার্যকারিতা বজায় রাখবে এবং একই সঙ্গে এর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করবে।

এটি কেবল নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং খাতের টেকসই উন্নয়ন এবং প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে। এমআরএ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক অনীহা এবং পরবর্তীকালে এর নিজস্বতাকে বোঝার চেষ্টা করে উপযোগী নিয়ম তৈরি করার ঘটনা ড. ইউনূসের এই যুক্তির বাস্তব প্রমাণ দেয় যে ক্ষুদ্রঋণের নিয়ন্ত্রণ প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের চেয়ে ভিন্ন জ্ঞান ও পদ্ধতির দাবি রাখে। একটি স্বতন্ত্র আইনি কাঠামো এই ভিন্নতাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে এবং ক্ষুদ্রঋণকে তার নিজস্ব গতিপথে বিকশিত হতে সাহায্য করবে।

ড. ইউনূসের এই ভাবনার বাস্তবায়নের পথে এমআরএ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল যখন ব্যাপক সাফল্য লাভ করে এবং এর অনুকরণে অসংখ্য এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে, তখন এই খাতের দ্রুত এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনা, সুদের হার নির্ধারণ এবং ঋণ বিতরণ ও আদায়ের পদ্ধতিতে ভিন্নতা দেখা দেয়, যা সম্ভাব্য সমস্যা এবং ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে খাতের সামগ্রিক শৃঙ্খলা রক্ষা, কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা এবং ঋণগ্রহীতাদের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়।

এমআরএ প্রতিষ্ঠা এই বাস্তব প্রয়োজন থেকেই উদ্ভূত হয় এবং এটি এই খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন। এটি প্রমাণ করে যে ক্ষুদ্রঋণ খাত একটি নির্দিষ্ট আকার এবং ব্যাপ্তি লাভ করার পর কেবল স্ব-নিয়ন্ত্রণ বা এনজিও কাঠামোর ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না, বরং এর জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো অপরিহার্য। এমআরএ প্রতিষ্ঠা এই খাতের পরিপক্বতা এবং আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।

যদিও ড. ইউনূস প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, তবে এমআরএ একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় এর জন্য উপযোগী নিয়মকানুন তৈরি করা সম্ভব হয়। এই নিয়মগুলো ক্ষুদ্রঋণের বিশেষ বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, যা খাতের বিলুপ্তি রোধ করে এর টেকসই বিকাশে সহায়ক হয়। এমআরএ প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়াটি ড. ইউনূসের ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, তবে সেই নিয়ন্ত্রণ হতে হবে খাতের নিজস্বতাকে সম্মান জানিয়ে এবং তার সুষ্ঠু বিকাশকে সম্ভব করে তুলে। এমআরএ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্ষুদ্রঋণ খাতের জন্য একটি উপযোগী নিয়ন্ত্রক মডেল তৈরি করে, যা পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বহু দেশের জন্য অনুসরণীয় হয়েছে, যা এই বাস্তবতার বিশ্বজনীন প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরে।

এমআরএ প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে এবং বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ খাতের যে শক্তিশালী এবং ইতিবাচক চিত্র গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্যে ওঠে এসেছে, তা ড. ইউনূসের ভাবনার পেছনের শক্তি এবং এই খাতের বাস্তব সাফল্যকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। বর্তমানে মাইক্রোক্রেডিট সেক্টরে বাংলাদেশের সমগ্র ব্যাংকিং খাতের প্রায় ১০ শতাংশ সমপরিমাণ সম্পদ ধারণ করা একটি অভাবনীয় অর্জন, যা এই খাতের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে নির্দেশ করে। সদস্যদের প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয় এবং প্রায় ৬১ হাজার কোটি টাকার পুঞ্জীভূত উদ্বৃত্ত এই খাতের আর্থিক সক্ষমতা ও স্বনির্ভরশীলতার এক শক্তিশালী প্রমাণ।

এটি নির্দেশ করে যে ক্ষুদ্রঋণ খাত এখন কেবল বাইরে থেকে আসা অনুদান বা স্বল্প সুদের ঋণের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি তার নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হওয়ার এবং অভ্যন্তরীণভাবে পুঁজি গঠনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। এটি কেবল দারিদ্র্যবিমোচনের একটি উপায় নয়, বরং নিজেই একটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের উচ্চ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে উচ্চ ঋণ আদায় হার এই খাতের নৈতিক ভিত্তি, কার্যকর পরিচালনা পদ্ধতি এবং ঋণগ্রহীতাদের দায়বদ্ধতার প্রতিফলন, যা প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রায়শই একটি দুর্বল দিক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বাস্তব সাফল্যই ড. ইউনূসের এই দাবিকে জোরালো ভিত্তি দেয় যে মাইক্রোক্রেডিটই আগামীদিনের ব্যাংকিংয়ের মূল চালিকাশক্তি হতে পারে।

তবে বর্তমান বাস্তবতায় কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান, যা খাতের ভবিষ্যতের গতিপথকে প্রভাবিত করতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের দ্রুত বিস্তার একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মাইক্রোক্রেডিটের ২৬ হাজারের মতো শাখার বিপরীতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ২০ হাজার ছাড়ানো শাখা নেটওয়ার্ক গ্রামীণ আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে একটি নতুন প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করছে। আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং এখন এজেন্ট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রবেশ করছে এবং বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা প্রদান করছে, যা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করছে। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সেবার ধরন, প্রযুক্তি ব্যবহার, পরিচালনা পদ্ধতির আধুনিকায়ন এবং গ্রাহক সম্পর্কোন্নয়নে নতুনত্ব আনতে হবে।

এই প্রতিযোগিতা মাইক্রোক্রেডিট খাতকে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে উৎসাহিত করতে পারেÑ এটি কি কেবল ক্ষুদ্রঋণ প্রদানে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি ড. ইউনূসের ভাবনার মতো আরও পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং সেবার দিকে প্রসারিত হবে? অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের মন্তব্য এই বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি এমআরএ-কে কেবল নিয়ন্ত্রক নয়, বরং খাতের প্রসারে সহায়তা করার ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। ইউজার ফ্রেন্ডলি রেগুলেশন এবং গ্রাহকদের জন্য সহজ শর্ত (যেমন- সঞ্চয়ের ওপর ন্যায্য রিটার্ন, সার্ভিস চার্জের যৌক্তিকতা) নিশ্চিত করা খাতের টেকসই বিকাশ এবং এর জনমুখী চরিত্র বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিকগুলো নির্দেশ করে যে বর্তমান বাস্তবতা কেবল খাতের আর্থিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং সেবার গুণগত মান উন্নয়ন, প্রতিযোগিতা মোকাবিলা এবং গ্রাহক সুরক্ষার মতো বিষয়গুলোকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি নিয়ে নতুন আইনের খসড়া তৈরির চলমান প্রক্রিয়া বর্তমান বাস্তবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই আইনটি যদি ক্ষুদ্রঋণকে একটি স্বতন্ত্র ব্যাংকিং কাঠামোয় রূপান্তরিত করার জন্য পথ খুলে দেয়, তবে তা ড. ইউনূসের ভাবনার বাস্তবায়নের পথে একটি বড় এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ হবে। আইনটি কীভাবে প্রণীত হয় এবং এতে ক্ষুদ্রঋণের বিশেষ প্রকৃতি, জামানতবিহীন মডেল এবং সামাজিক লক্ষ্যকে কতটুকু স্বীকৃতি দেয়া হয়, তার ওপর নির্ভর করবে খাতের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা।

এটি কি ড. ইউনূসের আকাক্সিক্ষত জামানতবিহীন, বিশ্বাসভিত্তিক ব্যাংকিং মডেলকে সমর্থন করে একটি নতুন ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করবে, নাকি প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের কিছু নীতিকে ক্ষুদ্রঋণের ওপর অযাচিতভাবে আরোপ করে এর মৌলিক চরিত্রকে পরিবর্তন করবে? এই আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি এবং এর চূড়ান্ত রূপরেখা ক্ষুদ্রঋণ খাতের ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং ড. ইউনূসের ভাবনার সঙ্গে বাস্তবতার সমন্বয় কতটা ঘটবে, তা স্পষ্ট করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এমআরএ যদি একসঙ্গে কাজ করে ক্ষুদ্রঋণকে আরও কার্যকর ও জনমুখী করতে পারে, তবে তা খাতের ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হবে।

সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাইক্রো ক্রেডিটকে ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখার ভাবনাটি অত্যন্ত দূরদর্শী এবং এটি ক্ষুদ্রঋণের অন্তর্নিহিত শক্তি, বিশেষ করে বিশ্বাস ও মানবিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হওয়ার অনন্য সক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার এই ভাবনা প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে একটি বিকল্প, আরও কার্যকর এবং জনমুখী আর্থিক মডেলের সম্ভাবনার দ্বার উšে§াচন করে। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ খাতের বর্তমান বাস্তবতা হলো এটি একটি বিশাল, শক্তিশালী এবং স্বনির্ভর আর্থিক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, যা নিজস্ব সঞ্চয় ও উদ্বৃত্তের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয় এবং একটি বিশেষায়িত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার (এমআরএ) অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে ক্ষুদ্রঋণ আর কেবল একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প নয়, বরং বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য এবং প্রভাবশালী অংশ হয়ে উঠেছে।

ড. ইউনূসের ভাবনা এবং বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে একটি স্পষ্ট যোগসূত্র বিদ্যমান। বাস্তবতা ধীরে ধীরে ড. ইউনূসের ভাবনার দিকে হয়তো এগিয়ে চলেছে, যেখানে ক্ষুদ্রঋণ তার এনজিও পরিচয় ছাড়িয়ে আরও সংহত, শক্তিশালী এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করছে। এটি প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের সমান্তরালে নিজস্ব পথে বিকশিত হচ্ছে, গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক চাহিদা মেটাতে একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। তবে এটি ঠিক তার কল্পনার মতো জামানতবিহীন, বিশ্বাসভিত্তিক একমাত্র ভবিষ্যৎ ব্যাংকিং মডেলে সম্পূর্ণরূপে রূপান্তরিত হবে কিনা, নাকি প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সহাবস্থান করবে, তা নির্ভর করে ভবিষ্যৎ নীতি, আইনি কাঠামো, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং খাতের ভেতরের ও বাইরের বিভিন্ন শক্তির মিথস্ক্রিয়ার ওপর।

এমআরএ-র নতুন ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি ছিল এই ভাবনা ও বাস্তবতার ছেদবিন্দুতে দাঁড়িয়ে খাতের বর্তমান অর্জনগুলো উদযাপন এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আলোচনা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে ক্ষুদ্রঋণ খাত একটি স্থির সত্তা নয়, বরং এটি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া, যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে এবং দারিদ্র্যবিমোচন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য অর্জনে নতুন নতুন পথের সন্ধান করছে। এই পথচলায় ড. ইউনূসের ভাবনা ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা দেয়, আর বাস্তবতা সেই পথের বাস্তব রূপরেখা তৈরি করে। ক্ষুদ্রঋণ খাতের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, এবং এর বিবর্তন প্রধান উপদেষ্টার ভাবনা ও বর্তমান বাস্তবতার আলোকেই এগিয়ে যাবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী