খরচ দাবির আড়ালে ৩.৪৩ কোটি টাকা কর দেয়নি ‘শাহজিবাজা ‘

খরচ দাবির আড়ালে ৩.৪৩ কোটি টাকা কর দেয়নি ‘শাহজিবাজা‘

রহমত রহমান: আয় হয়েছে প্রায় ৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। কিন্তু দেখানো হয়েছে প্রায় ৭৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আয় কম দেখানো হয়েছে প্রায় পৌনে ১৪ কোটি টাকা, যার ওপর কর দেয়া হয়নি প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। এই তিন খাতে খরচ দাবির আড়ালে এই করফাঁকি দেয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে তালিকাভুক্ত শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে আয় কম দেখিয়ে করফাঁকি দেয়ার এমন অভিযোগ উঠেছে। রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ২০১৯-২০ করবর্ষে এমন অনিয়ম উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রতিবেদন দিয়েছে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়ের অধীন রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর এনবিআরের আওতাধীন দশটি কর অঞ্চলের অধীনে ১৮টি কর সার্কেলের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ করবর্ষের করযোগ্য মোট আয় ও আয়কর নির্ধারণে সঠিকতা যাচাই সংক্রান্ত কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট তৈরি করে। যাতে ২০১৯-২০ করবর্ষে শাহজিবাজারের অনিয়ম উঠে এসেছে। শাহজিবাজার রাজধানীর সার্কেল-২৯, কর অঞ্চল-২-এর করদাতা প্রতিষ্ঠান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহজিবাজার ২০১৯-২০ করবর্ষের রিটার্নে আয় দেখিয়েছে ৭৪ কোটি ৮৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩৭ টাকা। তবে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর কোম্পানির রিটার্ন ও রিটার্নের সঙ্গে দেয়া কাগজপত্র যাচাই করেছে। এতে দেখা গেছে, তিন খাতে খরচ দাবি করা হয়েছে। যদিও এই তিনটি খাতে কর প্রযোজ্য। রিটার্নের সঙ্গে দেয়া বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘গিফট, ডোনেশন ও সাবস্ক্রিপশন’ বাবদ ৭ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ২৯ ধারা অনুযায়ী এই ধরনের খরচ বিয়োজন অনুমোদনযোগ্য নয় বিধায় মোট আয়ের সঙ্গে যোগাযোগ্য। বার্ষিক প্রতিবেদনে ‘ন্যাচারাল গ্যাস’ বাবদ ১৩ কোটি ১৯ হাজার ৫১৫ টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ৫২ ধারা অনুযায়ী এ খরচের ওপর ৩ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনযোগ্য। দাবি করা এই খরচের বিপরীতে কোনো উৎসে কর কর্তন চালানের কোনো কপি পাওয়া যায়নি। ফলে ধারা ৩০ (এএ) অনুযায়ী এ খরচ অননুমোদনযোগ্য ব্যয় হিসেবে গণ্য এবং মোট আয়ের সঙ্গে যোগযোগ্য। এছাড়া বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ক্যারিজ ইনওয়ার্ড’ বাবদ ৬৮ লাখ ২ হাজার ৮২১ টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী দাবি করা এই খরচের ওপর ৪ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনযোগ্য। কিন্তু নিরীক্ষার সময় উৎসে কর কর্তনের কোনো চালানের কপি পাওয়া যায়নি। ফলে ধারা ৩০ (এএ) অনুযায়ী, এ খরচ অননুমোদনযোগ্য ব্যয় হিসেবে গণ্য হবে এবং তা অন্যান্য উৎস হতে আয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগাযোগ্য।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করদাতা কোম্পানি শাহজিবাজার ২০১৯-২০ করবর্ষে মোট আয় দেখিয়েছে ৭৮ কোটি ৮৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩৭ টাকা। আর অডিট অধিদপ্তর বাড়তি তিন খাতে আয় পেয়েছে ১৩ কোটি ৭৫ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৬ টাকা। এ আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য কর ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ৯৫৯ টাকা, যা প্রতিষ্ঠান পরিহার বা ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানের জবাব চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলকে চিঠি দেয় রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর। জবাবে বলা হয়, নথিপত্র পর্যালোচনা করে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এ বিষয়ে শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানির কোম্পানি সচিব ইয়াসিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এগুলো কন্টিনিয়াস প্রসেস। এটা কোনো অপরাধ বা ওপেন্সের কিছু না। কখনও কিছু এক্সপেন্স এনবিআর ডিজঅ্যালাউ করে। সেটা প্রপার ব্যাখ্যা দেয়ার পরে আবার অ্যালাউ করে। এটা চলতে থাকে। কখনও কখনও আমরা ট্রাইব্যুনালে যাই। হাইকোর্টেও ট্যাক্সের অনেক মেটার পেন্ডিং আছে।’

অনিয়মের বিষয়ে শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তাকে (সিএফও) ভুলন ভৌমিক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পাওয়ার প্ল্যান্টে কোনো ট্যাক্স নেই। কী গোপন করেছি। এটা তো পাবলিক লিস্টেড কোম্পানি। পত্র-পত্রিকায় আছে, ওয়েবসাইটে আছে। অডিট অধিদপ্তর বললে তো হবে না। আর এটা তো মামলাধীন। তাদের কোনো রাইট আছে? আপিল, ট্রাইব্যুনাল, হাইকোর্ট আছে। মামলা কি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে? মামলা নিষ্পত্তি হোক, যদি ট্যাক্স পায়; নেবে। না হলে আমাকে দেবে। এটা নিয়ে কিছু যায় আসে না।’

উল্লেখ্য, শাহজিবাজার পাওয়ার ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১৮৬ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানির রিজার্ভে রয়েছে ৪০৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মধ্যে ৫৯ দশমিক ২১ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে, ১৬ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং ২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। কোম্পানিটি গত ২০২২ হিসাববছরে বিনিয়োগকারীদের মোট ২০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ নগদ ও ৪ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ। এছাড়া কোম্পানি ২০২১ সালে মোট ৩২ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল।