চলতি হিসাববছরের প্রথমার্ধ

খরচ বৃদ্ধিতে পুঁজিবাজারে আর্থিক খাতের আয়-মুনাফায় ধস

আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে ২৩টি নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট (এনবিএফআই) বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিকভাবে চলতি ২০২৩ হিসাববছরের প্রথমার্ধ বা প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) প্রান্তিকে ঋণ ও অগ্রিম আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেলেও সুদ আয় কিছুটা ও পরিচালন আয় বড় অংশে কমেছে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদ বাবদ খরচ বা ব্যয় আগের বছরের থেকে বৃদ্ধি পাওয়ায় আলোচ্য সময়ে নিট আয় এবং নিট মুনাফায় বড় ধস হয়েছে।

এতে চলতি হিসাববছরের প্রথমার্ধে তালিকাভুক্ত মোট ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদ আয় আগের বছরের থেকে কমেছে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর একই সময়ে কোম্পানিগুলোর পরিচালন থেকে আয় কমেছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বা ৩৭ শতাংশ। কিন্তু এর সঙ্গে কোম্পানিগুলোর নিট সুদ আয় কমেছে ১৭৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বা প্রায় ৭৮ শতাংশ। আর আলোচ্য সময়ে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা আগের বছরের থেকে কমেছে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা বা ৬০ শতাংশ।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সব ধরনের তফসিলি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খরচ কমানোর কিছু নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতেও কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়তই তাদের খরচ বাড়িয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় একটি অংশ ব্যয় হয়ে থাকে সুদ বাবদ। কোম্পানিগুলো যে আমানত নিয়ে থাকে, এর বড় একটি অংশ অগ্রিম ও ঋণ দিয়ে থাকে। বর্তমানে তারল্য সংকট থাকায় বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু এর বিপরীতে যে ঋণ বা অগ্রিম দিচ্ছে, তা থেকে খুব বেশি সুদ নিতে পারছে না তারা। তালিকাভুক্ত যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেগুলোর ২০২২ সালে আমানত এবং ঋণ ও অগ্রিমের মধ্যে সুদের পার্থক্য ছিল ২ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা ২০২২

 সালের প্রথমার্ধে ছিল ৩ শতাংশ। ২০২৩ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে সে পার্থক্য ২০২২ শেষে আরও শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ কমে হয়েছে ২ দশমিক ১০ শতাংশ। ফলে তারল্য সংকটের কারণে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করলে ঋণ ও অগ্রিমের সুদ কমে গেছে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে আয় ও মুনাফায় বড় রকমের পতন হয়েছে বলে জানান তারা।    

কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি হিসাববছরের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানিগুলোর ঋণ ও অগ্রিম ছিল ৪২ হাজার ১৭৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪১ হাজার ৮৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিগুলোর ঋণ ও অগ্রিম বেড়েছে এক হাজার ৯২ কোটি ৩০ লাখ টাকা বা ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর বিপরীতে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানিগুলোর সুদ থেকে আয় হয়েছে দুই হাজার ৪০ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে হয়েছে দুই হাজার ৪৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সে হিসাবে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিগুলোর সুদ আয় কমেছে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা বা শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ।

এদিকে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিগুলোর সুদ বাবদ থেকে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৯৮৯ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে হয়েছিল এক হাজার ৮১৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। সে হিসাবে ছয় মাসে কোম্পানির সুদ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ১৭৬ কোটি ১০ লাখ টাকা বা প্রায় ৯ শতাংশ। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিট সুদ আয়ে হয়েছে বড় পতন। ২০২৩ সালে প্রথমার্ধে কোম্পানিগুলোর নিট সুদ আয় হয়েছে মাত্র ৫১ কোটি টাকা। যেখানে আগের বছরের একই সময় হয়েছিল ২৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিগুলোর ১৭৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বা প্রায় ৭৮ শতাংশ নিট সুদ আয় কমেছে।

অপরদিকে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিগুলোর পরিচালন আয় হয়েছে এক হাজার ১৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে হয়েছে এক হাজার ৬১৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সে হিসাবে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিগুলোর পরিচালন আয় কমেছে ৫৯৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা বা ৩৭ শতাংশ। এসময় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৫৮৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরে একই সময় হয়েছে ৫৮৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিগুলোর পরিচালন ব্যয় কমেছে তিন কোটি ২০ লাখ টাকা।

এছাড়া আলোচ্য সময়ে কোম্পানিগুলোর প্রভিশন হয়েছে ১৬৯ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৪৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিগুলোর প্রভিশন কমেছে ২৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকা বা প্রায় ৬৪ শতাংশ। তবুও কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফায় বড় পতন হয়েছে আলোচ্য সময়ে। চলতি হিসাববছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা হয়েছে ১২৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময় হয়েছিল ৩১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা প্রায় ১৯০ কোটি টাকা বা ৬০ শতাংশ কমেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির আয় ও মুনাফায় পতন হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু খাতটির অধিকাংশ কোম্পানিতে এমন হয়েছে। ফলে দু-চারটি কোম্পানি ভালো করলেও বেশিরভাগ কোম্পানির অবস্থা শোচনীয়, যার প্রভাব সামগ্রিক খাতের ওপর পড়ে। এতে নির্দিষ্ট কোম্পানি ভালো করছে, কিন্তু পুরো খাতের ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে। আর খাতের ওপর আস্থা কমে গেলে ভালো কোম্পানির ব্যবসাও কমে যেতে থাকবে বলে জানান তারা।