মো. রমজান আলী : আগামীদিনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আউশ মৌসুমের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। আউশ ধান চাষ একদিকে যেমন পতিত জমির ব্যবহার বাড়াবে, তেমনি অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। উৎপাদনশীলতা ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির জন্যও কৃষি খাত বিশেষ ভূমিকা রাখছে এবং দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানও রাখছে, যা শ্রম শক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান জোগান এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কাঁচামাল সরবরাহ করছে।
দেশের কৃষিকাজ সাধারণত তিনটি প্রধান কৃষি মৌসুমে বিভক্ত: রবি, খরিপ-১ (আউশ) এবং খরিপ-২ (আমন)। এই তিনটির মধ্যে খরিপ-১ মৌসুমটি বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এই মৌসুমে উৎপাদিত প্রধান ফসল আউশ ধান ছাড়াও পাট, তিল, সূর্যমুখী, ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া, কচু, ঝিঙা, পটোল, বেগুন, করলা, ঢ্যাঁড়শ, বরবটি ও চিচিঙ্গাসহ নানা ধরনের মৌসুমি সবজি বাংলাদেশের কৃষির বহুমুখীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
খরিপ-১ মৌসুম সাধারণত মার্চ থেকে জুন-জুলাই পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে, যা গ্রীষ্মকালীন মৌসুম নামেও পরিচিত। খরিপ মৌসুমে তাপমাত্রা ও বায়ুর আর্দ্রতা বেশি থাকে এবং বর্ষার পূর্বপ্রস্তুতিমূলক বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তবে সম্পূর্ণ বর্ষা নেমে আসার আগেই এই মৌসুম শেষ হয়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা সীমিত থাকে। ফলে এই মৌসুমটি সেচনির্ভর কৃষিকাজের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেসব জমিতে শুষ্ক মৌসুমে ইরি ধানকাটা হয়, সে জমিকে পতিত না রেখে আউশ চাষের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
আউশ ধান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ফসল, যা খরিপ-১ মৌসুমে চাষ হয়। এটি একটি স্বল্পমেয়াদি ফসল যার জীবনকাল ৯০ থেকে ১২০ দিন। আউশ ধান সাধারণত সেচনির্ভর এবং তুলনামূলকভাবে কম পানিতে চাষযোগ্য। বর্তমানে উন্নত জাত ও হাইব্রিড বারি ধান ৪৮ ও বারি ধান ৬৫ জাতের আউশ ধান কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে; যা খরা সহনশীল এবং দ্রুত ফলন দেয়। তবে এর চেয়েও ভালো জাত বা মেগা ভ্যারাইটি ব্রি ধান-৮৩ নিয়ে আসা হচ্ছে। আউশ ধান রবি ও আমন মৌসুমের মাঝে একটি অতিরিক্ত ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। এতে জমির উৎপাদনশীলতা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি দেশের মোট ধান উৎপাদনেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব হয়।
খরিপ-১ মৌসুমে পাটও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের পাটশিল্প এক সময় বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থানে ছিল। বর্তমানে চাহিদা কিছুটা কমে গেলেও, তবুও পরিবেশবান্ধব এই আঁশের জন্য আবার নতুন করে বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। পাট জলাবদ্ধতা সহনশীল এবং নদীভাঙা বা বন্যাপ্রবণ এলাকাতে তুলনামূলকভাবে ভালো ফলন দেয়। এছাড়া সূর্যমুখী ও তিলের মতো তেলজাত ফসল এবং করলা, লাউ, বরবটি, শসা ইত্যাদি সবজি চাষেও এ মৌসুম অত্যন্ত উপযোগী।
ইরি বা বোরো কাটার পর জমি পতিত না রেখে খরিপ-১ মৌসুমের ফসল চাষ করে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায়। বার্ষিক খাদ্য নিরাপত্তায় মোট ধান উৎপাদনে আউশের অবদান দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ মৌসুমে একাধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত সম্ভব। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ও জাত ব্যবহার করে খরা সহনশীল আউশ ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করাও সম্ভব।
অনেক সময় দেখা যায় এই মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম হয়, তখন অধিকাংশ আউশ চাষ সেচের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় সেচের খরচ এবং পানির উৎসের ঘাটতি কৃষকদের আউশ চাষে নিরুৎসাহিত করে। এছাড়া সময়মতো উন্নত জাতের বীজ পাওয়া না গেলে ফলন কমে যায়। পর্যাপ্ত পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক কৃষক আউশ মৌসুমে ফসল নির্বাচন বা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন নন। যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন, খরার প্রকোপ, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং উষ্ণতার পরিবর্তন ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) কৃষি উৎপাদনবিষয়ক বৈশ্বিক তথ্য ভান্ডার স্ট্যাটিসটিক্যাল পকেটবুক অনুযায়ী বাংলাদেশ সবজি চাষের জমি বৃদ্ধির হারে এখন বিশ্বে প্রথম আর উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে সবজি উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। ফল বিশ্বে উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন শীর্ষে রয়েছে। ধান উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে, দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বিদেশে চালও রপ্তানি করছে। সরকারের সময়োপযোগী নীতি ও পদক্ষেপ এবং কৃষিবিদ, কৃষক, বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণ কর্মী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই কৃষির এ যুগান্তকারী সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে ই-কৃষির প্রসার এ সাফল্য অর্জনের অন্যতম সারথি হিসেবেও কাজ করেছে। আমাদের কৃষিতে তরুণ কৃষক ও উদ্যোক্তারা এখন সংযুক্ত হচ্ছেন। প্রযুক্তিবান্ধব এসব তারুণ্যের অমিত শক্তির সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার মিথস্ক্রিয়ায় বাংলার কৃষি হবে আরও সমৃদ্ধ ও দিগন্তজোড়া ফসলের সোনালি মাঠে বিস্তৃত হবে কৃষকের হাসি।
সরকার আউশ আবাদ বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের বীজ, সার, সেচসহ বিভিন্ন প্রণোদনার পাশাপাশি সারের দামও কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে কৃষি বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবন করে, গড় ফলনও বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বিঘা জমিতে ১৮ থেকে ১৯ মণ ধান উৎপাদিত হচ্ছে যা অত্যন্ত গর্বের ও অহঙ্কারের। অথচ এক সময় আউশ উৎপাদন বিঘাতে মাত্র ২ থেকে ৩ মণ হতো। সারা দেশে আউশের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিপণ্যের বাজারজাতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে সরকার। এ দেশের কৃষিপণ্যকে ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত দেশের বাজারে রপ্তানি করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সেজন্য পূর্বাচলে একটি অ্যাগ্রো প্রসেসিং সেন্টার করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি করা যায়।
পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপখাইয়ে ক্লাইমেট স্মার্ট এবং স্বল্প জীবনকালের অথচ উচ্চফলনশীল আউশ ধানের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)সহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশে প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্যের চাহিদাও বাড়ছে। বোরো ও আমন মৌসুমের ওপর বেশি নির্ভরশীল না হয়ে আউশ মৌসুমে উৎপাদন বাড়ানো হলে দেশে ধানের মোট উৎপাদন বাড়বে এবং খাদ্য ঘাটতির ঝুঁকিও কমবে। আউস মৌসুম বৃষ্টি নির্ভর হলেও এটি তুলনামূলকভাবে কম পানি চাহিদাসম্পন্ন। ভবিষ্যতে পানির ঘাটতির সময়ে বোরো মৌসুমের চেয়ে আউস ধান পরিবেশবান্ধব ও টেকসই একটি বিকল্প হতে পারে। বছরে তিন মৌসুমে ধান চাষ করা গেলে কৃষকরা বসে না থেকে অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন। মৌসুমে উচ্চফলনশীল জাত ও সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা হলে এ মৌসুম কৃষকের জন্য লাভজনক হয়ে উঠবে। যদি উৎপাদন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা উন্নত করা যায় তাহলে অতিরিক্ত ধান রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এতে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ মৌসুম চালু রাখলে কৃষি শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
ভূগর্ভস্থ পানির বেশি প্রয়োজন না হওয়ায় বৃষ্টিনির্ভর আউশ ধান চাষে কৃষকগণ আগ্রহী হয়ে উঠছেন, কারণ বীজ ও সার প্রান্তিক কৃষকদের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিচ্ছে সরকার, ফলে কৃষকরা আউশের উচ্চফলনশীল জাতের বীজ পেয়ে খুশি। তাছাড়াও আউশ ধান চাষে সেচ কম লাগে বিধায় উৎপাদন খরচও তুলনামূলকভাবে কম এবং কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। আউশের উচ্চফলনশীল জাত নির্বাচনের মাধ্যমে চাষের সঠিক নিয়ম মেনে চললে ভালো ফলন পাওয়া এবং সর্বোপরি স্বল্প উৎপাদন খরচে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। এ কথাগুলো কৃষকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কাজ করছেন কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাছাড়া গত কয়েক বছর ধরে আউশ মৌসুমকে সামনে রেখে সরকার কৃষকদের সরকারি প্রণোদনা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রণোদনার মধ্যে থাকছে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ ও সার। আউশ আবাদ বাড়ানোর পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও নিবিড় মনিটরিং। ফলে সেচসাশ্রয়ী আউশ আবাদে ব্যাপক সাড়া দিচ্ছেন কৃষকরা, যার সুফল পাচ্ছে সারা দেশ।
ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কৌশল হিসেবে আউশ মৌসুমকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে উপযুক্ত জাতের বীজ, সরকারি প্রণোদনা, সেচ সুবিধা, প্রশিক্ষণ এবং বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। যদি পরিকল্পিতভাবে এই মৌসুমকে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উšে§াচিত হবে। আউশ ধান, পাট ও অন্যান্য মৌসুমি ফসল খরিপ-১ মৌসুমকে একটি সম্ভাবনাময় সময় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে স্বল্পমেয়াদি, খরা সহনশীল ও বহুমুখী ফসল চাষের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে নীতিগত সহায়তা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই মৌসুমের উৎপাদনশীলতা বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব, যা দেশের কৃষকের আর্থিক সমৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখবে।
পিআইডি নিবন্ধ