এস এম রুবেল, কক্সবাজার: দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ কক্সবাজারের মহেশখালী। পাহাড়ের জন্যই দ্বীপটি পৃথিবী বিখ্যাত। ২০ বছর আগেও এখানকার পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখির আবাসস্থল ছিল। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে কয়েক প্রজাতির বানরের দেখা মেলে। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে বনের বানরগুলোও তাদের আবাসস্থল ছেড়ে লোকালয়ে ঘোরাঘুরি করছে।
জানা গেছে, পাহাড় কাটা ও বন উজাড় করার কারণে বানর হারিয়ে ফেলছে তাদের বসবাসের স্থান। প্রতিনিয়ত বানর বসবাসের জায়গা মানুষের কবজায় চলে যাচ্ছে। বনে খাবার সহসা মিলছে না, টান পড়েছে খাবারের। ফলে খাদ্যাভাবে বাধ্য হয়ে লোকালয়ে চলে আসছে এসব বানরের দল। গত বছর অক্টোবর মাসে পাহাড়ি দ্বীপে ক্ষেতে হানা দেয়ার অভিযোগ তুলে বিষ পান করিয়ে অর্ধশতাধিক বানর হত্যা করেন এক ব্যক্তি।
বড় মহেশখালী এলাকার তারেক, হাসান ও ছোট মহেশখালীর রাসেল, জমির জানান, লোকালয়ে বানরের দল প্রবেশ করে মানুষের শাকসবজির ক্ষেত নষ্ট করছে। এমনকি ছোট শিশুদের কাছ থেকে খাবার কেড়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
স্থানীয়রা জানান, আগে মহেশখালীর পাহাড়গুলো পশুপাখির অভয়ারণ্য ছিল। কালের পরিক্রমায় তাদের আবাস্থলে মানুষ হানা দিয়েছে। বছরের পর বছর পাহাড়ে বসতি স্থাপন, পাহাড় কর্তন ও বন উজাড় করার কারণে পাহাড়ি বনে বাস করা পশুপাখিদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে ইতোমধ্যে হরিণ, শুয়োর, অজগর, খরগোশসহ নানান প্রাণী প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। লোকালয়ের পাশে থাকা পাহাড়গুলোয় কোনো পশুপাখি বসবাস করে না। তবে গভীরে থাকা পাহাড়গুলোতে এখনও পশুপাখিদের বিচরণ দেখা যায়। তার মধ্যে বানরের দলকেই ছোটাছুটি করতে বেশি দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বনের ভেতরেই প্রাণীরা অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ। কিন্তু বন উজাড় ও পাহাড় নিধনের কারণে তারা লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। কখনও পথ হারিয়ে দিশা না পেয়ে বনের মতো কিছু দেখে প্রবেশ করছে কোনো গ্রামে।
শাপলাপুরের কয়েকজন কৃষক জানান, বনবিভাগের লোকজন বন রক্ষার পরিবর্তে বনের ক্ষতিই বেশি করছে। তারা নার্সারি করার নামে বনে আগুন দিয়ে বন পরিষ্কার করে, বন ও পাহাড় খেকোদের সঙ্গে আতাত করে পাহাড় ও গাছ কর্তন করে, কৃষকদের কাছ থেকে দাবিকৃত টাকা না পেয়ে কৃষকদের পানের বরজে আগুন দেয়। এছাড়া পাহাড়ের মধ্যে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। যে কারণে পাহাড়ি বনে বসবাস করা প্রাণিগুলো নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে লোকালয়ে চলে আসে।
মহেশখালী বনবিভাগের অফিস সূত্রে জানা গেছে, বানর ছাড়াও সজারু, গুঁই সাপ, অজগর, হরিণ, বুনো শুয়োর, মুখ পোড়া হনুমান, খরগোশ, কাঠবিড়ালীসহ নানা প্রজাতির প্রাণি রয়েছে বনে। বন্য পশু পাখিদের খাদ্যের অভাব মোচনে পাহাড়ি বনে ডুমুর, আমলকিসহ বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছ রোপণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, বন্যপ্রাণীর
জায়গায় মানুষের হানা পড়ায় বানর খাদ্যাভাবে ভুগছে। তাই লোকালয়ে আসতে পারে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্টের মহেশখালী উপজেলার সভাপতি দিনুর আলম বলেন, বন্যপ্রাণীর জন্য পর্যাপ্ত রিজার্ভ ফরেস্ট রাখা দরকার। যাতে তারা তাদের জন্য নিরাপদ একটি আবাসভূমিতে বিচরণ করতে পারে। তাদের খাদ্য সংকট ঘুচাতে পারে এবং খাদ্য শৃঙ্খল ঠিক থাকে। রিজার্ভ ফরেস্টে স্থানীয় কৃষকদের কোনোভাবেই অনুপ্রবেশ করতে দেয়া যাবে না।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনছারুল করিম বলেন, মহেশখালী দ্বীপ হচ্ছে পুরো দেশের আইসোলেশন কেন্দ্র ও সম্ভাবনাময়ী জায়গা। মহেশখালীর পাহাড়ে বাস করা পশুপাখিদের প্রজাতির সঙ্গে অন্যান্য বনের পশুপাখিদের প্রজাতির মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। দ্বীপে বসবাসের কারণে এখানে আলাদা বৈশিষ্টের পশুপাখিদের প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু পাহাড় ও গাছ কর্তন, পশুপাখি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা না থাকা ও পাহাড়ে খাদ্যাভাবের কারণে বনের বানরগুলো লোকালয়ে ঘোরাঘুরি করছে। এটি নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত। দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, মহেশখালীতে উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে মানুষ যেমন উদ্বাস্তু হচ্ছে, তেমনি প্রাণিজগত হুমকিতে পড়ছে। পশু-পাখিদের আবাসস্থল নিরাপদ না রাখলে খাবারের প্রয়োজনে তারা গ্রামাঞ্চলে চলে আসবে। তিনি আরও জানান, সামাজিক বনায়নের নামে সরকারী উদ্যোগেই বন ধ্বংস হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বন সংরক্ষণে উদ্যোগী না হওয়া এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের বেশ কয়েকটি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা মেনে না চলায় বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।