রেজাউল করিম সিদ্দিকী: প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী ইংরেজ শাসন এবং ২ দশকের বেশি পাকিস্তানি শাসন শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট দারিদ্র্যপীড়িত অপুষ্টির স্বীকার ও খাদ্য নিরাপত্তাহীন বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতা-উত্তরকালে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। স্বাধীনতা লাভের পর পর ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেশের খাদ্যনিরাপত্তা সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। এছাড়া ২০০৭-২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের সময় খাদ্যশস্য, জ্বালানি ও সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়। স্বাধীনতার পর পর এদেশের খাদ্য চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ হতো বৈদেশিক খাদ্য সহায়তা বিশেষ করে পিএল ৪৮০-এর আওতায় আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালে খাদ্য সাহায্য হিসেবে বাংলাদেশে ১.৩ মিলিয়ন টনের বেশি খাদ্য সাহায্য আসে, যা মোট আমদানির ৩৫ শতাংশেরও বেশি। ২০০৫ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ (ঐওঊঝ) এর তথ্য অনুযায়ী দেশের ৪০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ তাদের আয়ের ৭০ শতাংশ শুধু খাবারের জন্য ব্যয় করত। তা সত্ত্বেও জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ দিনে ১ হাজার ৮০৫ কিলো ক্যালোরির কম খাবার গ্রহণ করত, যা একজন মানুষের দৈনিক ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা ২১২২ কিলো ক্যালরির প্রায় ৮৫ শতাংশ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক খাদ্য সাহায্য কমতে থাকে। ফলে খাদ্য ঘাটতি পূরণে সরকার আমদানিকৃত খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু ২০০৭-২০০৮ সালের বৈশ্বিক খাদ্য সংকট এবং খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, খাদ্য ঘাটতি পূরণে আমদানিনির্ভরতা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যশস্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বণ্টন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সরকারের এসব পদক্ষেপের ফলে সাম্প্র্রতিক করোনা মহামারির অভিঘাত ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটেও বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হয়েছে। সাধারণভাবে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে একটি স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনমুখী জীবনযাপনের জন্য দেশের সকলের সকল সময়ে পর্যাপ্ত খাদ্যের লভ্যতা ও প্রাপ্তির সুযোগ থাকাকে বোঝায়। তবে খাদ্য নিরাপত্তাকে জাতীয় ও ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথকভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা বলতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত থাকাকে বোঝায়। অন্যদিকে ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে নিজস্ব উৎপাদন, বাজার অথবা সরকারি সরবরাহ থেকে সমাজের সবার জন্য খাদ্য চাহিদা পূরণের সুযোগ থাকাকে বোঝায়। কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে খাদ্য নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। বন্যা, সাইক্লোন, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায়ই এদেশের খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়। মাত্র ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশে ১৬ কোটির বেশি লোকের বাস। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। উপরন্তু বসতবাড়ি, কলকারখানা, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে প্রতি বছর এদেশে ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে। সাম্প্র্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ১.২ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন হ্রাস পাবে, যা বার্ষিক ধান উৎপাদন প্রায় চার শতাংশ। ২০০৭-০৮ সালের খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি থেকে স্পষ্টই প্রমাণ হয় যে, খাদ্যশস্যের মূল্য ও জোগানের স্থিতিশীলতার জন্য বিশ্ব বাজারের ওপর আর নির্ভর করা যায় না। ফলে এদেশের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার স্বনির্ভরতা (ংবষভ জবষরধহপব) থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা (ঝ ঝঁভভরপরবহপু) নীতি গ্রহণ করেছে। সময় উপযোগী ও কার্যকর এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশ খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিক সফলতা অর্জন করেছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্যশস্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
উৎপাদন বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি উন্নত জাতের শস্য ও তার চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন, এদের বিস্তার, প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থা, সার, কীটনাশক, বীজ ও আনুষঙ্গিক কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা। এজন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় কৃষি গবেষণা ব্যবস্থায় (ঘঅজঝ) ৫০০ এর বেশি উন্নত জাতের শস্য ও তাদের চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। কম ফলনশীল স্থানীয় জাতের পরিবর্তে এসব উন্নত জাতের ফসল আবাদ করায় ফলন বেড়েছে, উৎপাদন খরচ কমেছে এবং লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডিজেল ইঞ্জিন আমদানি উদারীকরণ, আমদানি শুল্ক হ্রাসকরণ, ক্ষুদ্র সেচ যন্ত্রপাতি বিশেষ করে অগভীর নলকূপের ওপর থেকে স্ট্যান্ডারডাইজেশন সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ইত্যাদি কারণে ক্ষুদ্র সেচ কার্যক্রমে বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও ডিজেলের মাধ্যমে সেচ কাজে ভর্তুকি প্রদান করায় কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৯ সালে সরকার বেসরকারি খাতকে হাইব্রিড ধানের বীজ আমদানির সুযোগ দেয়। ফলে উচ্চফলনশীল জাতের হাইব্রিড ধানের বীজের বাজার উল্লেখযোগ্যভাবে সাম্প্রসারিত হয়েছে। সারের বিপণন ব্যবস্থা বেসরকারিকরণ করা হয়, ১৯৭৮ সালে যা আশির দশকে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে বেসরকারি ডিলারদের ফ্যাক্টরি ও বিএডিসি সরবরাহ কেন্দ্র থেকে হ্রাসকৃত মূল্যে সার সংগ্রহ ও বিপণনের অনুমতি দেয়া হয়। ১৯৯৫ সালে বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজারে সারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। ফলে ১৯৯২ সালে প্রত্যাহারকৃত নন-ইউরিয়া সারের ওপর ভর্তুকি পুনরায় চালু করা হয়। বর্তমান অবধি সরকার ট্রিপল সুপার ফসফেট (ঞঝচ) ও মিউরেট অফ পটাশ (গচ) সারে অধিক পরিমাণে ভর্তুকি প্রদান করছে। এর ফলের রাসায়নিক সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে, জমির উর্বরতা ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান সরকার গত ১৫ বছরে এদেশে কৃষি খাতে যে ধারাবাহিক উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছে তা সত্যিই অকল্পনীয়। খাদ্য ঘাটতি নিয়ে স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব সরকারই কম বেশি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু বিগত ১৫ বছরে কৃষি ক্ষেত্রে যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে তা অতীতের যে কোনো সময়ের সফলতা ও অগ্রগতির চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে চালের মোট উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ টন। এ সময় দেশে গম, ভুট্টা, আলু ও সবজির মোট উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৮ লাখ ৪৯ হাজার, ৭ লাখ, ৫ লাখ ও ৩০ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি খাতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি ও প্রণোদনা প্রদান, প্রয়োজনীয় সার, বীজ, কীটনাশক ও কৃষি যন্ত্রপাতির সহজলভ্যকরণ, কৃষির আধুনিকীকরণ, উন্নত জাতের ফসল ও তার চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য ধারাবাহিক গবেষণা, কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শসেবা প্রদান ইত্যাদি কারণে গত ১৫ বছরে এসব খাদ্যশস্যের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪৫ পার্সেন্ট বৃদ্ধি পেয়ে ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে ভুট্টা, আলু ও সবজির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৬৪ লাখ, ১ কোটি ৪ লাখ ও ২ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টনে এসে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কৃষিপণ্য বিশেষ করে খাদ্যশস্য বিপণন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং বিতরণ ব্যবস্থাও শক্তিশালী করা হয়েছে। নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লাভের প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। বাজার ব্যবস্থায় একচেটিয়া ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য প্রতিহত করতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)র মাধ্যমে সারাদেশে পাঁচ কোটি মানুষকে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল, ডাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে।
যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামগ্রিক উন্নয়নের প্রথম ধাপ জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এজন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় দেশের সব সরকার কমবেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান সরকার একে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে সর্বাত্মক কর্মসূচির হাতে নিয়েছে এবং তার সফল বাস্তবায়ন করেছে ও করছে। সব স্তরের জনগণ ইতোমধ্যেই এর সুফল ভোগ করছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে এই সাফল্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
পিআইডি নিবন্ধ