মো. আরিফ উল্লাহ: বর্তমান সময়ে খাবার অপচয় যেন নতুন এক ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠান কিংবা কোনো বড় রেস্তোরাঁ বা ফাস্ট ফুডের দোকানে খাবারের একটা অংশ না রাখলে যেন নিজের সম্মানে আঘাত হানে। কিন্তু আমরা কখনোই ভাবি না খাবারের অভাবে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে প্রতিদিন কত মানুষ মারা যাচ্ছে, এমনকি আমাদের দেশেই অনেক মানুষ ঠিকমতো ২ বেলা ভাত খেতে পায় না, খাদ্যদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বাসি খাবার রাস্তার পাশ থেকে কিনে খাচ্ছে, কারণ অধিকাংশ উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার পরিবারের মানুষকে বাজার থেকে মাংস কিনে খাওয়ানোর সামর্থ্য রাখে না। সিন্ডিকেট নামক নতুন সামাজিক ব্যাধির কারণে অকারণে ৩০ টাকার কাঁচা মরিচ ৭০০ টাকা, ৪০ টাকার পেয়াঁজ ৪০০ টাকা করতে মোটেও দ্বিধা করে না। অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে দিন কাটানো এই মানুষগুলো আমাদের আশপাশেই আছে। কিন্তু আমরা কেন জানি তাদের কষ্ট অনুভব করতে পারি না, তাদের সবসময় নজরান্দাজ করে থাকি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর তথ্য মতে করোনা মহামারি, বর্তমানে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ অনাহারের রেকর্ড সংখ্যা দেখছে বিশ্ব। যার সংখ্যা প্রায় ৮২ কোটি ৮ লাখ মানুষ, সংক্ষেপে বললে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন মানুষ অনাহারে ভোগে। এছাড়া ২০২১ সালের ৯ জুলাই অক্সফাম ‘দ্য হাঙ্গার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’ নামক এক প্রতিবেদনে উঠে আসে আরও ভয়ঙ্কর এক তথ্য যেখানে বলা হয়েছে বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১১ জন মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কিছু মানুষ নিরন্তর খাদ্য অপচয় করেই চলেছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা নিতান্তই নিছক অজুহাতে খাবার অপচয় করি। আমরা কখনও আফ্রিকার সেই দেশগুলোর দিকে তাকাই না। আমরা রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষের খবর নিই না। আমাদের পাশে মধ্যবিত্ত পরিবারটি না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে তার খবর নিতে আগ্রহ দেখাই না।
খাবার অপচয়ে থেমে থাকিনি, আমরা খাবারের পাশাপাশি খাদ্যশস্য অপচয়েও কম যাই না। মাঠ থেকে সবজি, শস্য কিংবা ফলমূল বাজারজাতকরণ পর্যন্ত অবহেলার কারণে নষ্ট হয় অনেক খাদ্যশস্য। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তাদের গবেষণায় উঠে আসে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য মাঠ থেকে ভোক্তার প্লেটে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে অপচয় হয়, যার শতকরা হিসেবে প্রায় ২৫ শতাংশ, আর বার্ষিক পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ টন। এই অপচয়কৃত খাদ্যশস্য যদি সংরক্ষণ করা যায় তাহলে তা ১ কোটি মানুষের ১ বছরের খোরাক মেটাতে সক্ষম হবে। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শরাঞ্চলে এই অপচয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যার মধ্যে প্রথম কাজটি হলো আমাদের যুব সমাজের ধারণার পরিবর্তন করা যে অন্যের তথাকথিত প্রেস্টিজের নামে খাবার অপচয় না করে, খাবার থেকে উৎকৃষ্ট চাহিদা গ্রহণ করা। তাদের মধ্যে এই অনুভূতি তৈরি করা যে খাবার প্লেটের সামান্য পরিমাণে খাবার ফেলে দেয়াও অপচয়। কারণ যুব সমাজের ধারণা পরিবর্তন করতে পারলে আগামীর অনেক প্রজন্ম একই পথ অনুসরণ করবে। এছাড়া বিভিন্ন খাবার হোটেল, বিয়েবাড়ি, কনভেনশন হলে সচেতনতামূলক পোস্টার ব্যবহার করা যেখানে নানান রকম বাণীর সঙ্গে বর্তমান সময়ের ভয়ঙ্কর অবস্থা তুলে ধরা হবে। এছাড়া ধর্মীয় উপাসনালয়ের মাধ্যমে অপচয় রোধে প্রচারণা চালানো যেতে পারে, কারণ সব ধর্মই অপচয়কে নিরুৎসাহিত করেছে। আমরা আরও কিছু পদক্ষেপ হাতে নিতে পারি, যেমন খাবারের ধরন পরিবর্তন করা অর্থাৎ এমনভাবে আহার গ্রহণ করা যেন অবশিষ্ট খাবার অন্য একজন মানুষ কোনো দ্বিধা ছাড়াই গ্রহণ করতে পারে, সেই সঙ্গে রেস্টুরেন্ট, বিয়েবাড়ি এবং কনভেনশন হলে ফুড ব্যাংক তৈরি করা, যেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় খাবারের একটি অংশ সে পার্সেল করে কোনো হতদরিদ্র মানুষকে দিতে পারে।
বর্তমান সময়ের চেয়ে আগামীর পৃথিবী আরও অনেক কঠিন হতে চলেছে, যখন বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, তাই আমাদের অপচয় রোধ করতে হবে, আরও মিতব্যায়ী হতে হবে, তাহলেই সবার জন্য পৃথিবী শান্তিময় হবে।
উন্নয়ন কর্মী