নিজস্ব প্রতিবেদক: রোজার আগে বাজারের কেনাকাটা বাড়তি চাপ। বাজারে সবকিছু আগের মতো হলেও, এ বছর বাজারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। প্রতিবছর রোজা শুরুর আগেই বাজারে খেজুর, চিনি, ছোলা বেসনের মতো পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এবার এই পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর এ পণ্যগুলোর দাম বৃদ্ধি না পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষই। বিক্রেতারা স্বস্তি প্রকাশ করে বলছেন, দাম নাগালের মধ্যে থাকায় ক্রেতাদের কেনাকাটার চাহিদা আছে; যা বিক্রেতাদের জন্য ভালো। রমজান-সংশ্লিষ্ট এসব নিত্যপণ্যের দাম না বাড়লেও এরই মধ্যে শসা, লেবু ও বেগুনসহ সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর রমজান মাসকে কেন্দ্র করে রোজা শুরুর আগেই বাজার উত্তপ্ত থাকে। বাড়তে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য থাকে খেজুর, শসা, লেবু, বেগুন, ছোলা, ডাল, বেসনের মতো পণ্য। সে হিসেবে এবারের চিত্র কিছুটা ভিন্ন।
বাজারে দেখা যায়, মানভেদে প্রতি কেজি বাংলা খেজুর ১৮০-২০০ টাকা, মেডজুল খেজুর ১২০০-১৬০০ টাকা, আজোয়া খেজুর ৯০০-১৩০০ টাকা, কামরাঙা মরিয়ম খেজুর ৭০০-১৮৫০ টাকা, মরিয়ম খেজুর ৬০০ টাকা, তিউনিসিয়ার খেজুর ৪৫০ টাকা, কাঁচা খেজুর ৬০০ টাকা, মাশারুক ৭০০-৯০০ টাকা, সুগাই জাতের খেজুর ৯৫০ টাকা, দাব্বাস খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪৬০- ৫০০ টাকা, জাহিদি ২০০-৩০০ টাকা এবং বরই খেজুর ৪৫০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খেজুর বিক্রেতা আবুল বাসার বলেন, খেজুরের দাম এ বছর অনেক কম। যে খেজুর গত বছর ১ হাজার টাকা বিক্রি করেছি; সেটা এবার ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছি। আরেক বিক্রেতা মো. ইয়াসিন বলেন, এবার খেজুরের দাম কমেছে। আর আগে যে রকম রোজা এলেই দাম বেড়ে যেত এবার সে রকম দাম বাড়েনি। আশা করি, দাম আর বাড়বেও না।
এ সময় আল-আমিন নামের এক ক্রেতা খেজুরের দাম নিয়ে বলেন, খেজুর তো আসলে অনেক রকমের আছে। একেক খেজুরের একেক দাম। যে যার সাধ্য অনুযায়ী কেনে। এবারের ব্যাপারটা কিন্তু আলাদা। আলাদা হচ্ছে এভাবে, আগের বছরগুলোয় আমাদের মিনিমাম দামের খেজুর কিনতে হয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। এবার আমরা ২০০ টাকায়ও কিনতে পারছি। এক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হচ্ছে, খেজুরের দাম নাগালের মধ্যেই আছে।
উল্লেখ্য, এনবিআরের পক্ষ থেকে রমজান মাসে খেজুরকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য খেজুর আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে অর্থাৎ মোট করহার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর এনবিআরের এই সিদ্ধান্তের ফলেই খুচরা বাজারে কমেছে খেজুরের দাম। রোজাকে কেন্দ্র করে খেজুরের দাম না বাড়লেও বেড়েছে শসা, লেবু, বেগুনের দাম। এগুলোর মধ্যে লেবুর দাম বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। এছাড়া বাজারে আজকে কয়েকটি সবজি বাদে প্রায় সব সবজির দাম রয়েছে বাড়ন্ত পর্যায়ে। বাজারে প্রতি কেজি টক টমেটো ৩০ টাকা, দেশি গাজর ৩০ টাকা, শিম ৪০-৫০ টাকা, লম্বা বেগুন ৬০ টাকা, সাদা গোল বেগুন ৬০ টাকা, কালো গোল বেগুন ৭০ টাকা, শসা ৪০-৬০ টাকা, উচ্ছে ৮০ টাকা, করলা ১০০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মুলা ২০ টাকা, লাল মুলা ৩০ টাকা, শালগম ৩০ টাকা, ঢেঁড়স ১০০ টাকা, পটোল ১৫০ টাকা, চিচিঙা ৬০ টাকা, ধুন্দল ৬০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, পেঁয়াজকলি ৪০ টাকা, কচুর লতি ১০০ টাকা, মুখিকচু ১০০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৩০ টাকা, কাঁচামরিচ ৮০ টাকা, ধনেপাতা ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। মানভেদে প্রতিটি লাউ ৬০ টাকা, চালকুমড়া ৬০ টাকা, ফুলকপি ৪০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০ টাকা করে বিক্রি হয়। এছাড়া প্রতি হালি কাঁচাকলা ২৫ টাকা, হালি লেবু বিক্রি হয় ৬০ টাকা করে।
এক মাস আগের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, প্রতি কেজিতে টক টমেটোর দাম কমেছে ১০ টাকা, দেশি গাজরের দাম কমেছে ১০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজিতে লম্বা বেগুনের দাম বেড়েছে ২০ টাকা, সাদা গোল বেগুনের দাম বেড়েছে ১০ টাকা, কালো গোল বেগুনের দাম বেড়েছে ১০ টাকা, শসার দাম বেড়েছে ১০-২০ টাকা, শিমের দাম বেড়েছে ১০ টাকা, উচ্ছের দাম বেড়েছে ২০ টাকা, করলার দাম বেড়েছে ৩০ টাকা, শালগমের দাম বেড়েছে ১০ টাকা, ঢেঁড়সের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা, পটোলের দাম বেড়েছে ৭০ টাকা, চিচিঙার দাম বেড়েছে ১০ টাকা, বরবটির দাম বেড়েছে ১০ টাকা, পেঁয়াজকলির দাম বেড়েছে ২০ টাকা, কচুর লতির দাম বেড়েছে ৪০ টাকা, মুখিকচুর দাম বেড়েছে ২০ টাকা, কাঁচামরিচের দাম বেড়েছে ২০ টাকা, ধনেপাতার দাম বেড়েছে ৭০ টাকা। আর প্রতি পিসে ফুলকপির দাম বেড়েছে ২০ টাকা, চালকুমড়ার দাম বেড়েছে ১০ টাকা। আর প্রতি হালিতে লেবুর দাম বেড়েছে ৩০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য সবজির দাম রয়েছে অপরিবর্তিত।
সবজির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ জানিয়ে বিক্রেতা মো. রাজীব বলেন, সবজির দাম যে রোজার কারণে বেড়েছে এমন নয়। এখন আসলে শীত শেষ হয়েছে, এই সিজনের সবজি শেষের দিকে। তাই সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। আবার নতুন সিজনের সবজি আসছে, সেগুলোরও দাম বেশি, যেহেতু সেগুলো নতুন। তাই এই মাঝামাঝি সময়ে সবজির দাম কিছুটা বাড়তি।
এদিকে সবজির দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাজার করতে আসা ক্রেতারা। মাহফুজুর রহমান নামের এক ক্রেতা বলেন, সবজির দাম কিন্তু অনেকটা নীরবেই বেড়ে গেল। খুব যে বেড়েছে সেটা বলা যাবে না; মানে নাগালের বাইরে বলা যাবে না। কিন্তু বেড়েছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। না হলে রোজায় এগুলো আমাদের আবার ভোগাবে। সবজির দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে আরেক ক্রেতা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, এখনই যদি এমন হয়, তাহলে তো রোজায় মনে হচ্ছে আরও খারাপ হবে দামের অবস্থা। যে দাম আছে সেগুলো এখনও সহনীয়। এর বেশি যাতে না হয়, সেটা লক্ষ রাখতে হবে। বাজারে মান ও আকারভেদে প্রতি কেজি নতুন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ৪০-৫০ টাকায়। এর মধ্যে ছোট আকারের পেঁয়াজ ৪০ টাকা এবং বড় আকারের পেঁয়াজ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া গতকাল প্রতি কেজি নতুন সাদা আলু বিক্রি হয় ২০-২৫ টাকা, নতুন লাল আলু ২০-২৫ টাকায়। নতুন বগুড়ার আলু ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। এছাড়া নতুন দেশি রসুন ১২০ টাকা, চায়না রসুন ২৪০ টাকা, চায়না আদা ২০০-২২০ টাকা, নতুন ভারতীয় আদা ১৪০ দরে বিক্রি হয়।
এক্ষেত্রে গত এক মাসের সঙ্গে তুলনায় করলে দেখা যায়, আজ মানভেদে প্রতি কেজিতে নতুন দেশি সাদা আলুর দাম কমেছে ৫ টাকা, নতুন দেশি লাল আলুর দাম কমেছে ৫ টাকা করে। আর প্রতি কেজিতে নতুন বগুড়ার আলুর দাম কমেছে ৫ টাকা। আর পেঁয়াজের দাম কমেছে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজিতে চায়না রসুনের দাম বেড়েছে ১০-২০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম ছিল অপরিবর্তিত।
এ সময় আলু পেঁয়াজের বিক্রেতারা জানান, রোজায় আলু-পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। গত এক মাসের ব্যবধানে এখনও স্বস্তি ফেরেনি মাংসের বাজারে। বরং বেড়েছে গরু ও খাসির মাংসসহ মুরগির মাংসের দাম। বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা এবং খাসির মাংস বিক্রি হয় ১২০০ টাকা কেজিদরে। এছাড়া গতকাল ওজন অনুযায়ী, ব্রয়লার মুরগি ১৯৭-২১০ টাকা, কক মুরগি ২৭০-২৯৫ টাকা, লেয়ার মুরগি ৩০০ টাকা, দেশি মুরগি ৬০০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়। ফার্মের মুরগির প্রতি ডজন লাল ডিম ১২০ টাকা, সাদা ডিম ১২০ টাকা।
এক্ষেত্রে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ২০ টাকা, খাসির মাংসের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৪-১০ টাকা, লেয়ার মুরগির দাম বেড়েছে ১০-১২ টাকা এবং দেশি মুরগির দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। এদিকে কক মুরগির দাম কমেছে ২০-৩৫ টাকা। এছাড়া প্রতি ডজনে সব ধরনের ডিমের দাম কমেছে ১০ টাকা। বাজারে আকার ও ওজন অনুযায়ী ইলিশ মাছ ১২০০-২৫০০ টাকা, রুই মাছ ৩৫০-৬০০ টাকা, কাতল মাছ ৩৫০-৫০০ টাকা, কালিবাউশ ৪০০-৬০০ টাকা, চিংড়ি মাছ ৮০০-১৬০০ টাকা, কাচকি মাছ ৪০০ টাকা, কৈ মাছ ২০০-১০০০ টাকা, পাবদা মাছ ৪০০-৬০০ টাকা, শিং মাছ ৪০০-১২০০ টাকা, টেংরা মাছ ৬০০-১০০০ টাকা, বোয়াল মাছ ৫০০-১০০০ টাকা, শোল মাছ ৬০০-৮০০ টাকা, মেনি মাছ ৬০০ টাকা, চিতল মাছ ৭০০-১০০০ টাকা, সরপুঁটি মাছ ২৫০-৪০০ টাকা, রূপচাঁদা মাছ ৮০০-১২০০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়।
অন্যান্য সময় রমজান মাস শুরুর আগেই বেসন, ডাল, ছোলা, চিনির মতো মুদি পণ্যের দাম বাড়তে থাকলেও এবার কিন্তু এখনও তেমন কিছু ঘটেনি। এখনও এসব পণ্যসহ অন্যান্য মুদি পণ্যের দাম অপরিবর্তিত ছিল। তবে দাম অপরিবর্তিত থাকলেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সয়াবিন তেল। সয়াবিন তেলের সংকটে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে।
বরাবরের মতো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষেরই অভিযোগ, তারা তেল পাচ্ছেন না। বিক্রেতারা বলছেন, তারা বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত তেল পাচ্ছেন না। আর ক্রেতারা বলছেন, তাদের তেলের জন্য প্রতিনিয়ত ঘুরতে হচ্ছে এ দোকান থেকে সে দোকানে। আবার শুধু তেল তারা কিনতে পারছেন না, সঙ্গে নিতে হয় অন্যান্য পণ্য। বাজারে প্রতি কেজি বুটের বেসন ১৪০ টাকা, অ্যাংকর বেসন ৮০-৯০ টাকা, ছোট মসুরের ডাল ১৩৫ টাকা, মোটা মসুরের ডাল ১১০ টাকা, বড় মুগ ডাল ১৪০ টাকা, ছোট মুগ ডাল ১৭০ টাকা, খেসারি ডাল ১১০ টাকা, বুটের ডাল ১২০ টাকা, মাষকলাইয়ের ডাল ১৯০ টাকা, ডাবলি ৬০ টাকা, ছোলা ১২০ টাকা, প্যাকেট পোলাওয়ের চাল ১৫০ টাকা, খোলা পোলাওয়ের চাল মানভেদে ১১০-১৩০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়। আর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৭৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৫৭ টাকা, প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা, খোলা চিনি ১২০ টাকা, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০ টাকা, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১১৫ টাকা, খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ১৯০ টাকায় বিক্রি হয়।