মো. সুলাইমান: বিগত সরকারের সময়ে দেশের ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজার ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তখনকার সরকারের সরাসরি মদতে এসব খাতে লুটপাট হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন নেতৃত্ব সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ দেয়া নিয়ে নতুন নিয়ম করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর গতকাল রোববার ছিল পুঁজিবাজারে প্রথম কার্যদিবস। আর এদিন লেনদেন হওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২০টির বা ৫৫ দশমিক ৫৫ শতাংশের শেয়ারদর কমেছে। অপরদিকে শেয়ারদর বেড়েছে মাত্র ছয়টি ব্যাংকের, আর অপরিবর্তিত ছিল ১২টির। ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ-সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব শেয়ার দরের ওপরে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে। নামে-বেনামে এ খাত থেকে টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এসব অর্থের বেশিরভাগ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এতে কয়েকটি ব্যাংক খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দেয়ায় সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। আর এজন্যই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থার ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। আর লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর জন্য খেলাপির যে শর্ত দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে অধিকাংশ ব্যাংকই লভ্যাংশ দিতে পারবে না। কারণ বেশিরভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত ছয় মাসে ব্যাপকহারে বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটি মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। বর্তমানের এ খেলাপি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা বেশি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রোববার এবি ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমেছে ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার দশমিক ৫৮ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংকের ১ দশমিক ১৪ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংকের ২ দশমিক ৬১ শতাংশ, ডাচ্্-বাংলা ব্যাংকের দশমিক ৫৯ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংকের ১ দশমিক ১৬ শতাংশ, আইএফআইসির ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংকের ১ দশমিক ১৪ শতাংশ, যমুনা ব্যাংকের ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংকের ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংকের দশমিক ৯৪ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংকের ২ দশমিক ২৭ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের ২ দশমিক ২২ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ দশমিক ১১ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংকের দশমিক ৪১ শতাংশ, পূবালী ব্যাংকের দশমিক ৬৮ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ১ দশমিক ৩১ শতাংশ, এসবিএসি ব্যাংকের ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ, সাউথইস্ট ব্যাংকের ২ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের দশমিক ৪৫ শতাংশ শেয়ার দর কমেছে।
এছাড়া শেয়ার দর বেড়েছে ছয়টি ব্যাংকের। এর মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের দশমিক ৪৩ শতাংশ, আইসিবির ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের দশমিক ৭৯ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ শতাংশ, ইউসিবির ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং উত্তরা ব্যাংকের দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ারদর বেড়েছে। ডিএসই সূত্রে আরও জানা গেছে, এদিন ১২টি ব্যাংকের শেয়ার দর অপরিবর্তিত ছিল। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটি ব্যাংকের শেয়ার দর ২২ টাকা ৯০ পয়সা, এক্সিম ব্যাংকের ৬ টাকা ৬০ পয়সা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৪ টাকা ৯০ পয়সা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ টাকা ৯০ পয়সা, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ১০ টাকা ১০ পয়সা, ন্যাশনাল ব্যাংক ৪ টাকা ৪০ পয়সা, এনআরবিসি ব্যাংক ৮ টাকা ৪০ পয়সা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১৮ টাকা ৮০ পয়সা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ারদর ৩ টাকা ৯০ পয়সায় অবস্থান করছে।
তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ নিয়ে নতুন নীতিমালার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ১০ শতাংশের বেশি এমন ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ দিতে পারবে না। আমরা রেগুলার যে সিএল শিট তৈরি করি, নতুন নিয়মের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনা করা হবে না। কারণ সিএল শিটের তথ্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই বাংলাদেশ ব্যাংকে দিয়ে থাকে। তখন খেলাপি কম দেখানোর একটা প্রবণতা থাকে ব্যাংকগুলোর। এজন্য লভ্যাংশ দেওয়ার নতুন নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর খেলাপি চিহ্নিত করতে বিশেষ পরিদর্শন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংকগুলোর বোর্ড, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংক আলোচনার মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নীতিমালা চলতি বছরের সমাপ্ত বছরের লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কভিডের কারণে ২০২০ সাল থেকে লভ্যাংশ বিতরণের ওপর বিধিনিষেধ দিয়ে আসছে। এত দিন কেবল প্রভিশন সংরক্ষণে ডেফারেল সুবিধা নেয়া ব্যাংকের লভ্যাংশ বিতরণের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ ছিল। এবার নতুন করে অনেক ধরনের শর্ত যুক্ত করা হয়েছে।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, একটি ব্যাংক কেবল বিবেচ্য পঞ্জিকাবষের্র মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ দিতে পারবে। কোনোভাবেই পুঞ্জীভূত মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রেও আরও কিছু শর্ত মানতে হবে। কোনো ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণের হার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের বেশি হলে লভ্যাংশ দিতে পারবে না। ঋণ, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে কোনো ধরনের সংস্থান ঘাটতি থাকা যাবে না। আবার সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতির কারণে আরোপিত দণ্ড সুদ ও জরিমানা অনাদায়ী থাকলে লভ্যাংশ দিতে পারবে না। প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডেফারেল সুবিধা বহাল থাকা অবস্থায় লভ্যাংশ দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২২ ও ২৪ ধারা যথাযথ পরিপালন করতে হবে।
সব শর্ত পরিপালন করলেও লভ্যাংশ বিতরণের একটি সীমা মানতে হবে ব্যাংকগুলোকে। আর ঘোষিত লভ্যাংশের পরিমাণ কোনোভাবেই পরিশোধিত মূলধনের ৩০ শতাংশের বেশি হবে না। নীতিমালায় বলা হয়েছে, যেসব ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানোর পর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে আড়াই শতাংশ আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয়সহ (ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার) ন্যূনতম ১৫ শতাংশ মূলধন থাকবে, ওই ব্যাংক সামর্থ্য অনুযায়ী লভ্যাংশ দিতে পারবে। তবে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ৫০ শতাংশের বেশি হবে না। আবার এমনভাবে লভ্যাংশ দেওয়া যাবে না, যাতে করে লভ্যাংশ-পরবর্তী মূলধন পর্যাপ্ততার হার সাড়ে ১৩ শতাংশের নিচে নেমে যায়। কনজারভেশন বাফারসহ যেসব ব্যাংকের সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি, তবে ১৫ শতাংশের কম মূলধন থাকবে তারা সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে লভ্যাংশ-পরবর্তী কোনোভাবেই মূলধনের হার সাড়ে ১২ শতাংশের নিচে নামতে পারবে না। আর যেসব ব্যাংকের মূলধনের হার ১০ শতাংশের বেশি, ওই ব্যাংক যত মুনাফাই করুক কেবল স্টক লভ্যাংশ দিতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নীতিমালা চলতি বছরের সমাপ্ত বছরের লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ২০২৪ সালের সমাপ্ত বছরে লভ্যাংশের ক্ষেত্রে ২০২১ সালের নির্দেশনা মানতে হবে। তবে ওই নির্দেশনায় ডেফারেল নেওয়া ব্যাংকের ৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেওয়ার যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। ফলে ডেফারেল সুবিধা নেয়া ব্যাংক ২০২৪ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারবে না।