খেলাপি ঋণের থলের বেড়াল বেরিয়ে আসছে

শেখ শাফায়াত হোসেন : আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করে। খেলাপি ঋণ বাড়তে বাড়তে বর্তমানে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংক খাতে তিন মাসে (জানু-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫২ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা। এর ফলে মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকায়। গতকাল রোববার এ তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের তুলনায় খেলাপি ঋণের হার বেড়ে হয়েছে ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পরিচালিত কোটা সংস্কার আন্দোলনের জের ধরে সংগঠিত জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ বাড়ার ৫টি কারণ ছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে একটি বড় কারণ, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মেয়াদি ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সময় পুনর্নির্ধারণ করেছে। যার ফলে অনাদায়ী ঋণ আগের থেকে কম সময়ে খেলাপি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ কর্তৃক কয়েকটি গ্রাহকের বৃহদাংকের ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকৃত করা, গ্রাহকের চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া, পুনঃতফসিলকৃত ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ না হওয়া ও বিদ্যমান বিরূপমানে শ্রেণিকৃত ঋণ হিসাবের বিপরীতে সুদারোপ করায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে থাকে। এর আগে যে এ ধরনের খেলাপি ঋণ লুকানো হতো বা উইন্ডো ড্রেসিং করা হতো তা এখন স্পষ্ট। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো প্রভিশন ঘাটতিও লুকানোর চেষ্টা করেছে। এখন আর সেই ধরনের লুকোচুরি সম্ভব হচ্ছে না বলে খেলাপি ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

তবে এ নিয়ে চিন্তিত না হওয়ার পরামর্শ দেন এই ব্যাংক এমডি। তিনি বলেন, এগুলো নতুন খেলাপি ঋণ নয়। অর্থাৎ এখন যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো দিচ্ছে সেগুলো খেলাপি হচ্ছে তা নয়। এত দিন লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ বের হচ্ছে বলে খেলাপি ঋণ বেশি দেখাচ্ছে।

বর্তমানে খেলাপি ঋণ ও শ্রেণিকৃত ঋণের আলাদা তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, খেলাপি ঋণ ৩ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা হলেও শ্রেণিকৃত ঋণ ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা; যা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায় মার্চে শ্রেণিকৃত ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।

ব্যাংক ক্যাটেগরি ওয়ারী শ্রেণিকৃত ঋণ পরিস্থিতি: গত মার্চ শেষে সরকারি ৬ ব্যাংকে (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক, বিডিবিএল) খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। বিশেয়াতি (কৃষি ব্যাংক ও রাকাব) খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মার্চ শেষে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে শ্রেণিকৃত ঋণের গ্রস হার ছিল ৪৫.৭৯ শতাংশ। এই হার বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ২০.১৬ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকে ৪.৮৩ শতাংশ ও বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহে ১৪.৪৭ শতাংশ। পক্ষান্তরে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে শ্রেণিকৃত ঋণের গ্রস হার ছিল ৪২.৮৩ শতাংশ। এই হার বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ছিল ১৫.৬০ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকে ৪.১৩ শতাংশ ও বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহে ১৪.৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ বিগত ত্রৈমাসিকের তুলনায় বর্তমান ত্রৈমাসিকে রাষ্ট্র-মালিকানাধীন বাণিজ্যিক, বেসরকারি ব্যাংক, বিদেশি ব্যাংক এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর শ্রেণিকৃত ঋণের গ্রস হার যথাক্রমে ২.৯৬ শতাংশ পয়েন্ট, ৪.৫৬ শতাংশ পয়েন্ট, ০.৭০ শতাংশ এবং ০.১০ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, শ্রেণিকৃত ঋণ ও খেলাপি ঋণের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যদিও উভয়ই ঋণের গুণমান প্রায় একই। শ্রেণিকৃত ঋণ হলো এমন ঋণ, যা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বা যাদের গুণমান কম বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, খেলাপি ঋণ হলো সেই ঋণ যা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পরিশোধ করা হয়নি। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ হলো শ্রেণিকৃত ঋণের একটি অংশ, যা শর্ত মোতাবেক পরিশোধ করা হয়নি।

শ্রেণিকৃত ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণের হার ৮১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর ব্যাংকগুলোর প্রভিশন (ব্যাংকের আয় থেকে টাকা দিয়ে ঋণের বিপরীতে সংরক্ষণ করাই হচ্ছে প্রভিশনিং) দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ১০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে এই প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি খেলাপি ঋণে জর্জরিত পাঁচ ইসলামি ধারার ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোর ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করে। তাদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলমসহ আরও কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।