শেখ আবু তালেব: খেলাপিঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রমেই নাজুক হচ্ছে ন্যাশনাল ফাইন্যান্স লিমিটেডসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ ও আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণ।
প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের ৮০ শতাংশই আদায় অযোগ্য মন্দ মানের ঋণ। এতে আয়ের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে। ফলে সামগ্রিক আয় কমে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। আর আয় কমলেও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিস ও গাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১২৬ কোটি টাকা, যা মোট ৭৯৬ কোটি টাকা ঋণের প্রায় ১৬ শতাংশ। অথচ তিন মাস আগেও অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ ছিল ১০৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৩ শতাংশ। এ হিসেবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ছয় শতাংশীয় পয়েন্ট।
এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। আর এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় খাত থেকে অর্থ দিয়ে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে বেশি হারে মুনাফার অর্থ প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়। আর বর্ধিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। অপরদিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল আটকে যায়। এতে কমে যায় বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। অর্থাৎ কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ করতে না পারলে কমে যায় আয়। অপরদিকে বেড়ে যায় তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ও জনগণের কাছ থেকে একটি নির্ধারিত হারে আমানত সংগ্রহ করে। নির্ধারিত সময় শেষে মুনাফাসহ আমানতকারীদের ফেরত দিতে হয়।
এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করে তার ৮০ শতাংশ বেশি মুনাফায় বিনিয়োগ করে। অর্থাৎ ঋণ প্রদান করে। এখন ঋণের অর্থ ফেরত না এলে অর্থাৎ খেলাপি হয়ে গেলে একদিকে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল কমে যায়। আবার এ খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে কমে যায় আয়।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বর্ধিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে কমে গেছে আয়। যেমন গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছিল ৩৮ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে গ্রাহকদের কাছ থেকে সঞ্চয় বা আমানত সংগ্রহের পরিমাণ কমেছে ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের। ২০১৭ সালে ডিসেম্বর শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৮৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ওপরে। ২০১৮ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৪৩০ কোটি ৩৪ লাখ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৬৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
অথচ আমানত কমলেও বৃদ্ধি পেয়েছে ঋণ। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি মেয়াদি ঋণ দিয়েছে ৪৮৫ কোটি টাকার। ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫১ কোটি ৪১ লাখ টাকায়। এক বছরের ব্যবধানে মেয়াদি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সঞ্চয় ৬৫ কোটি টাকা কমলেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে ৬৬ কোটি টাকার ওপরে।
তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা প্রতিষ্ঠানটি বর্ধিত এই বিনিয়োগ করতে ধার বাড়িয়েছে। ২০১৭ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও এজেন্টের কাছ থেকে ঋণ করেছিল ১৪৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ২০১৮ সাল শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৬২ কোটি ৩০ লাখ টাকার বেশি। এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫ কোটি ২৫ লাখ টাকার।
ব্যাংক থেকে ধার কমলেও বেড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। ফলে ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ সুদে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নিতে হয়েছে। ধার বৃদ্ধি পাওয়ায় এ বাবদ সুদ ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি আমানত ও ধারের বিপরীতে সুদ ব্যয় করেছে ৫৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০১৮ সাল শেষে পরিশোধ করেছে ৬১ লাখ ৪৮ লাখ টাকার। এক বছরের ব্যবধানে সুদব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে সাত কোটি এক লাখ টাকা।
২০১৬ সালে নিট সুদ আয় ছিল ২৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। পরবর্তী বছরে ১৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ কমে ২০১৭ সালে দাঁড়ায় ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। ২০১৮ সালে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কিন্তু দুই বছর পরও সুদ আয়ে পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতি বছর আয়ের তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশি। পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে গত তিন বছর ধরেই। ২০১৬ সালে পরিচালন ব্যয় ছিল সাত কোটি ৯৮ লাখ, ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয় ৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে হয় ১১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তিন বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে তিন কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ আয়ও কমেছে গত বছরে। ২০১৭ সালে বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছিল পাঁচ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৪২ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ থেকে আয় কমেছে দুই কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
কোম্পানির আয়ের উৎস সংকুচিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৫ লাখ টাকা বেশি। অফিস ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে সাত লাখ ১৩ হাজার টাকা। লিজ নেওয়া গাড়ির পেছনে এক বছরে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে গাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয় ছিল ২৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে তা হয়েছে ৫৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
বেড়েছে প্রতিষ্ঠানটির আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণের পরিমাণও। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির মন্দ ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ কোটি ৫১ লাখে। এক বছরের ব্যবধানে মন্দ ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৯ কোটি আট লাখ টাকার বেশি। এর বাইরে ২০১৮ সালে রাইট অফ করা হয়েছে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮ সালে শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস হয়েছে ৮১ পয়সা; যা ২০১৭ সালে ছিল ৭৫ পয়সা। অথচ ২০১৭ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইপিএস ছিল ৭৯ পয়সা।
ইপিএস নিয়ে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে দুই রকম তথ্য রয়েছে। কোম্পানির অন্যান্য বিষয় ও ইপিএস নিয়ে ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের কোম্পানি সচিব নাজমুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বিষয়টি জানানোর জন্য সময় চান। পরে গতকাল তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, এখন সামনে ফাইন্যান্সিয়াল ডেটা নেই। তাই এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।
