বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক

খেলাপি বৃদ্ধি ১২ হাজার কোটি আদায় ৪ হাজার কোটি টাকা

রোহান রাজিব: ব্যাংক খাতে আগ্রাসীভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। কিন্তু সেভাবে বাড়ছে না আদায়ের পরিমাণ। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার ৮১৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৯৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনার সময়ে ব্যবসায়ীদের খেলাপি ঋণ ঠেকাতে যে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। সে সুবিধা উঠে যাওয়া আদায় সামান্য বেড়েছে। তবে খেলাপি ঋণ সেভাবে কমেনি। নতুন করে আবার সুবিধা দেয়ায় খেলাপি বেড়ে যাবে এবং আদায়ের পরিমাণও কমে যাওয়ার শঙ্কা করছেন তারা।

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১ সালে একজন ঋণগ্রহীতার যে পরিমাণ ঋণ শোধের কথা, ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে তা নিয়মিত রাখা হয়। সম্প্রতি এক নির্দেশনার মাধ্যমে একটি খেলাপি ঋণ চার দফায় ২৯ বছর পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়েছে। সব পর্যায়ে ডাউনপেমেন্টের হার কয়েকগুণ কমানো হয়েছে। আবার পুনঃতপশিলের পর নতুন ঋণ নিতে আগে যেখানে ১৫ শতাংশ কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট দেয়া লাগত এখন তা ৩ শতাংশে নামানো হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) খেলাপিদের থেকে আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৯৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আদায় বেড়েছে ২ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা বা ১১৩ শতাংশ। ২০২১ সালের একই সময়ে এ আদায়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে আদায় বেড়েছে ২ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। প্রথম প্রান্তিকে আদায়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১১ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে সে তুলনায় আদায় কম হওয়ার কারণ হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ শিথিল নীতি। এর ফলে দেখাচ্ছে খেলাপি বাড়ছে আদায় কম হচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের জন্য সার্কুলার ঠিক আছে। অন্যদিকে কিছু ব্যবসায়ী এটার সুযোগ নিয়ে টাকা পরিশোধ

করছে না। এর ফলে ব্যাংকে টাকা আসছে না এবং ব্যাংক নতুন করে লোন ক্রিয়েট করতে পারছে না। এখন শিথিলতা কমিয়ে ব্যাংকের উচিত হবে কঠোর হওয়া। বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য উপায়ে আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের উচিত নিজ ইচ্ছায় টাকা পরিশোধ করার মনোভাব তৈরি করা।

খেলাপিদের কাছ থেকে নগদ, অবলোপন করা খেলাপি ও অন্যান্য আদায়ের হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবলোপন করা খেলাপি ঋণ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিপত্র থেকে বাদ দিয়ে আলাদাভাবে হিসাব করা হলেও তা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত। অবলোপন ঋণসহ জুন শেষে ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের অঙ্ক ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রতিবেদনে দেখানো হচ্ছে খেলাপি ঋণের অঙ্ক ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। এ সময় নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে আরও প্রায় ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে খেলাপিদের কাছ থেকে নগদ আদায় ৩ হাজার ৮৫৭ কোটি এবং অন্যান্য ২৪১ কোটি টাকা। এছাড়া অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় হয়েছে ৩৫৭ কোটি টাকা। আর প্রথম প্রান্তিকে নগদ আদায় ছিল এক হাজার ৬২৩ কোটি টাকা এবং অন্যান্য ১৮১ কোটি টাকা। অবলোপন থেকে আদায় ২০৭ কোটি টাকা।

দেশের ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকÑসোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকÑসম্মিলিতভাবে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৬৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আদায় করেছে। এসব ব্যাংকে জুন পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ থেকে ২ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। ৯টি বিদেশি ব্যাংক ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা আদায় করেছে। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। এছাড়া তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক ৪৩৫ কোট টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছে। তাদের এনপিএলের পরিমাণ ৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা।

এদিকে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ৩ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এ সময় সুদ মওকুফ করা হয় ২ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এ তিন মাসে পুনঃতফসিল করা ঋণের মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো করেছে ৮২২ কোটি এবং বেসরকারি ব্যাংক করেছে ২ হাজার ২১১ কোটি টাকা। বাকি ৬৭১ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছে বিশেষায়িত ব্যাংক।