Print Date & Time : 16 August 2025 Saturday 3:52 pm

গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার জয়

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তুমুল গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। গতকাল দুপুর ১টার পর তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ৩৬ দিন আগে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার পর দেশজুড়ে সংঘাত আর তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুর মধ্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হলো। ভারতের একটি কূটনৈতিক সূত্র ইঙ্গিত দিয়েছে, শেখ হাসিনার গন্তব্য আগরতলা।

সূত্রটি জানিয়েছে, ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ সেখানে বাংলাদেশের মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায়, বাংলাদেশে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের’ সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হচ্ছে। বিবিসি লিখেছে, শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়েছেন। তার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানাও রয়েছেন। তারা গেছেন ভারতের আগরতলায়। পরে সেখান থেকে একটি বিমানে করে দিল্লিতে যান।

শেখ হাসিনাকে বহনকারী সামরিক বাহিনীর বিমানটি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির কাছে হিন্দনে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি ঘাঁটিতে অবতরণ করেছে। ভারতের সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া নিশ্চিত করেছে এ তথ্য। এক প্রতিবেদনে ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার জানায়, সদ্য পদত্যাগ করা শেখ হাসিনা ভারতে কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, সোমবার রাতেই তিনি লন্ডনে রওনা হবেন। পরে একটি অসমর্থিত সূত্র জানায়, ব্রিটেন হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে।
এদিকে সর্বাত্মক অসহযোগের মধ্যে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়া জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনও দখলে নেয় গতকাল। সেখানে পতাকা হাতে তাদের উš§ুক্ত উল্লাসের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন, প্রতিটি হত্যা, অবিচারের বিচার হবে। সবার চেষ্টায় দেশে শান্তি ফিরে আসবে।

প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে নিহত হওয়ার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথম সরকার গঠন করেন তার মেয়ে শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার জয়ী হয়ে টানা ১৫ বছর দেশ শাসন করেন। নানা বিতর্কের মধ্যেও সবশেষ তিনটি নির্বাচনে ক্ষমতা টিকে রাখতে পারলেও এবার গণআন্দোলনের মধ্যে তাকে পদ ও দেশ ছাড়তে হলো। সূত্রমতে, কোটাপ্রথা নিয়ে এবারের আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় দফা আন্দোলন। মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে আন্দোলন থেমে গিয়েছিল। পরে আদালতের এক রায়ের পর দ্বিতীয় দফা আন্দোলন শুরু হয় গত জুন থেকে। এরপর তা ক্রমান্বয়ে সহিংস রূপ নেয়। এ অবস্থায় সরকার সব ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয় ১৭ জুলাই।

এদিকে কয়েকদিন আটক রাখার পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেয়া হয় ১ আগস্ট। বেলা দেড়টার পরই তারা ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের একটি গাড়িতে বেরিয়ে আসেন। রাতে ছাড়া পাওয়া অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। তিনি লিখেছেন, ‘ছয় দিনের ডিবি হেফাজত দিয়ে ছয়জনকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই বাংলাদেশের পুরো তরুণ প্রজš§কে কীভাবে আটকে রাখবেন? দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন প্রতিনিয়ত, সেগুলো কীভাবে নিবৃত্ত করবেন?’ সারজিস যুক্ত করেন, ‘পরিশেষে এটুকু বলতে চাই, এ পথ যেহেতু সত্যের পথ, ন্যায়ের পথ, তাই যে কোনো কিছু মোকাবিলা করতে আমরা বিন্দুমাত্র বিচলিত নই। যত দিন না এ বাংলাদেশ আন্দোলনকারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে, তত দিন এ লড়াই চলবে।’

৩১ জুলাই জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচির পর বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ। এই দিনের কর্মসূচির নাম দেয়া হয়েছিল ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’। ৩০ জুলাই বুধবার সন্ধ্যায় সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশিদের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, এমন ভয়ানক অন্ধকার পরিস্থিতিতে সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে এবং ছাত্র সমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ওইদিন সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সাবেক ছাত্রনেতাদের মতবিনিময়ের জন্য ডেকে কথা বলতে না দেয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় সাবেক ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ ‘ভুয়া ভুয়া’ বলেও সেøাগান দেন।

৩০ জুলাই হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল করা হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতি, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙের ফ্রেমে রাঙিয়েছেন অনেকে। এসব ব্যক্তির মধ্যে শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ আছেন। অন্যদিকে সরকার-সমর্থকদের অনেকে ফেসবুক প্রোফাইলে কালো রঙের ফ্রেম জুড়েছেন। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ কর্মসূচি পালন করা হয় দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস এবং রাজপথে।

পরে ছাত্ররা ৯ দফা থেকে সরাসরি শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা করে। গত ৩ আগস্ট বিক্ষোভ ও ৪ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হয়। অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্র-জনতার ত্রিমুখী সংঘর্ষে ৯৮ জন নিহত হন। এ সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করা হয়। এতে অংশ নিয়ে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা গতকাল ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথে নেমে আসে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে পদত্যাগে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।