মোহাম্মদ আবু নোমান: কত লিপ্সা! কত লোলুপতা! কত চেষ্টা! কত প্রয়াস ক্ষমতায় টিকে থাকার। আদতে কি শেষ রক্ষা হবে? বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। কে দেবে আশা! কে দেবে ভরসা? হত্যা, হামলা ও রক্তাক্তের ঘটনা ঘটছেই। লোভ লালসার ঊর্ধ্বে নিখাদ দল ও দেশপ্রেমী কোথায়! রাজনীতি এখন পলিটিক্সে ঢুকে পড়েছে। বিরোধীদের দমনের জন্য শক্তি প্রয়োগের ভয়াবহ প্রবণতার সূচনা আজকে হয়নি। মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, মোফাজ্জল হোসেন মায়া, নাসিম, আসাদুজ্জামান নূরসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা মিছিলে পুলিশের বেধড়ক মার খেতে খেতে মাটিতে শুয়ে পড়তেন! এই বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের নেতারা একসময় রাজপথে রক্তাক্ত হয়েছেন। এখন ঘটছে উল্টোটি। আজ তারাই শিকার।
গত দেড় মাসে বিএনপির সিরিজ কর্মসূচিতে ভোলায় নূরে আলম, আব্দুর রহিম, নারায়ণগঞ্জে শাওন, মুন্সিগঞ্জে শহিদুল ইসলাম ও যশোরে আব্দুল আলিমসহ পাঁচজন নিহত হন। তার মধ্যে পুলিশ চারজনকে গুলি করে এবং একজনকে আওয়ামী নেতারা হত্যা করে বলে অভিযোগ। মামলা গ্রেপ্তারও অব্যাহত। সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে রড, দা, চাপাতি, হকিস্টিক, লাঠি দিয়ে ছাত্রদলের নেতাদের ওপর এলোপাতাড়ি হামলা চালায়। বিএনপির আমলেও শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদলের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। হাতের রগ, পায়ের রগ কাটা, খুন হওয়া, বিশেষ করে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রদল ও শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিষয় কারও অজানা নয়।
অবাক করার বিষয় হলো, যে আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে তুমুল ও দুর্বার আন্দোলন, সংগ্রাম করে ভোটের অধিকার হরণকারী শাসকদের তটস্থ করে রাখত, সেই তারাই আজ ভীতসন্ত্রস্ত! অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। একটি পুরোনো রাজনৈতিক দল জনরায়কে ভয় পেতে পারে না। মিটিংয়ের জবাব হামলা চালিয়ে মিটিং পণ্ড করা নয়; বরং তাদের চেয়েও বড় সমাবেশ করে দেখিয়ে দেয়া, তোমাদের চেয়ে আমাদের জনসমর্থন কম নয়। পুলিশের ছত্রছায়ায় বিরোধী দলকে মিটিং করতে না দেয়ার মধ্যে সরকারি দলের কোনো বাহাদুরি নেই। আওয়ামী লীগের এই অসহায়ত্ব সত্যিই অবাক করার মতো।
বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কয়েক ঘণ্টা আগে অবস্থান করে মাঠ দখল নেয়ার ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি স্থানেই বিএনপির কর্মসূচিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ তথা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা হাতে ওই এলাকায় মিছিল ও মহড়া দিয়ে থাকে। কোথাও কোথাও সমাবেশস্থল থেকে নেতাকর্মীদের হটিয়ে বিএনপির প্ল্যাকার্ডে আগুন ধরিয়ে দেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
গত ১৪ বছরে যাদের হাতে দেশের খাজানা ছিল, তাদের কেন ক্ষমতা ধরে রাখতে কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। আওয়ামী লীগ দেশের যে উন্নয়ন করেছে সেগুলো নিয়ে সর্বসাধারণের কাছে যেতে পারে। দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, করোনা মোকাবিলায় সফলতা, অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, যোগাযোগ ব্যবস্থায়, খাদ্য উৎপাদনে, কর্মসংস্থানে উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি, আইটি সেক্টরে বলতে গেলে বিপ্লব ঘটিয়ে সারাবিশ্বের সঙ্গে নিবিড় ও সহজ যোগাযোগ স্থাপন। বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা, শিক্ষাভাতা, মুক্তিযোদ্ধাভাতাসহ বেশকিছু ভাতার প্রবর্তন ও বৃদ্ধি। সরকারি চাকরিজীবী ও শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তিকরণ, এরকম উল্লেখ করার মতো বহু বিষয় রয়েছে। সত্য কথা- আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তাণ্ডব, নৈরাজ্য কমাতে পারলে আওয়ামী লীগ জনগণের আরও কাছে যেতে পারত। বর্তমানে শুধু বিএনপির কঠিন সময় নয়, কঠিন সময় যাচ্ছে একটা রাষ্ট্রের। ২০০৯ সালের ১৮ বছরের অনেক যুবক, যে কি না গত ১৪ বছরে ভোট দেয়ার অধিকার পায়নি।
একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটাধিকার আদায়ের জন্য কেনই বা আন্দোলন করতে হবে? বাংলাদেশের ইতিহাসই হলোÑ(১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৯০) গণ-আন্দোলনে জয়ী না হয়ে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হয়নি। দেশের জন্য দুর্ভাগ্য, আন্দোলনে রক্তঝরা ও নিহত না হয়ে জনগণ তার ন্যায্য অধিকার ফিরে পায়নি। ভোটের নামে নাটকের অভিনয় ’৭৯ থেকে এখন পর্যন্ত সব দলই করেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা সর্বদাই অনিবার্য। যার মূল কারণ ছাড় দেয়ার মানসিকতা কারও নেই। জনগণের সেবার নামে জনগণকে জিম্মি করাই যেন বর্তমান রাজনীতির মূল লক্ষ্য। এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে রাজনীতিতে কখনোই স্থিতিশীলতা আসবে না। এ দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে মানুষ শঙ্কিত। এক দল চায় ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে, আরেক দল চায় যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসতে। আজকে আওয়ামী লীগ সবাইকে শিখিয়ে দিয়ে গেলে কীভাবে বিরোধী দমন করে বহুদিন আরামে চেয়ারে বসে থাকা যায়।
বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ বাস্তবিক এক ও অভিন্ন (কাজে), শুধু নামে ভিন্ন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ফারাক কেবল সেøাগান আর মার্কায়! অতীতে যারাই ক্ষমতায় ছিলেন, তারা জানতেন, ক্ষমতা ছাড়লেই শত-সহস্র কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় আটক হবেন। তাই যেকোনো উপায়ে আমৃত্যু ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা জারি রাখবেন। বিএনপিও ঠিক একই কারণে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করার চেষ্টা করেছিল ২০০৭ সালে। হিটলারের নাৎসি পার্টি, মিয়ানমার জান্তা সরকার বা পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে ‘মানবাধিকার’ নিয়ে চিৎকার করে বুক ফাটায়, বড় বড় কথা বলে, এতে কি হাস্যরস তৈরি হবে না? তেমনি বিএনপির এত এত অপকর্ম জমে আছে যে, তারা যত যা-ই বলুক মানুষ সব কিছু ভুলে যায়নি। বিএনপির সময় শেখ হাসিনার ওপর কয়েকবার গুলি ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট অকল্পনীয় এক নারকীয় নৃশংস গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের জš§ দেয়। মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের নারকীয় গ্রেনেড হামলার কথা মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রক্ত, বাঁচার জন্য আর্তচিৎকার ও বীভৎস লাশের ছবি। যার বলি হয়েছিল ২৪টি তরতাজা প্রাণ। আজও শত শত আওয়ামী লীগ কর্মী গ্রেনেডের স্পিøন্টারের ক্ষত ও যন্ত্রণা নিয়ে পঙ্গু জীবন পার করছেন। এরপর আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতে শুরু হয় নানা নাটক। তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নিতে জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে মঞ্চস্থ হয় ‘জজ মিয়া’ নাটক। পরে এটি হাস্যকর সাজানো নাটক প্রমাণ হওয়ার পর থামিয়ে দেয়া হয় তদন্তকাজ।
বিএনপির সময় লোডশেডিং, চাঁদাবাজি, হাওয়া ভবনের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ তোষণ, সন্ত্রাস, অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা অপকর্মে দেশকে ডুবিয়ে রেখেছিল।
নির্বাচন কমিশন বা সরকার মুখে যতই বলুক সামনের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, মাঠের চিত্র কিন্তু ভিন্ন। নির্বাচনের নামে দেশে পেশিশক্তি পরীক্ষার মহড়া শুরু হওয়া। নির্বাচন মানে এ দেশে বাঁচা-মরার লড়াই। আর লড়াইটা যেহেতু বাঁচা-মরার, তাই যেকোনো উপায়ে জিততে ন্যূনতম কোনো দ্বিধা নেই কারও। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আবার যদি নির্বাচন নিয়ে নতুন করে কোনো সংকট তৈরি হয়, তাহলে এই মুহূর্তে এই ঝামেলা সামাল দেয়াটা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। অসহ্য বাজারদাম, শহরে, গ্রাম-গঞ্জে, হাটে-মাঠে মানুষের মনে শান্তি নেই। বিশ্ব তথা বাংলাদেশের এই চরম সংকটকালে নির্বাচন নিয়ে আরেকটি সংকটের ভার বহন করার ক্ষমতা দেশের নেই। সাধারণ মানুষ শান্তি চায়। রাস্তাঘাটে নিরাপদে চলতে-ফিরতে চাই। যেকোনো দলের রাজনৈতিক সমাবেশ নাজানি অ্যাম্বুলেন্সে অসুস্থ কেউ বা সাধারণ পথচারীদের ভয়াবহ মরণ ফাঁদ তৈরি!
সম্প্রতি সারাদেশে যা ঘটছে, তা প্রায় অভাবনীয়। বিএনপির সমাবেশ বা মিছিলেই শুধু যে হামলা হয়েছে, তাই নয়, নেতাদের বাড়িঘরে, তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়েছে। আটকের সংখ্যা হিসাবের উপায় নেই। এসব হামলায় পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত আছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এসে দুই দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে রাজনৈতিক সমঝোতা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সমঝোতা হয়নি। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিএনপির নেতারা সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে, একঘেয়েমি করে নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দেয়। আমরা মনে করি ওটাই ছিল বিএনপির আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তখন শেখ হাসিনা নির্বাচনের সময় সরকারের ভাগাভাগি, এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদও বিএনপিতে দিতে চেয়েছিলেন। পরে ২০১৮ সালে বিএনপি সে রকম কোনো সুবিধা ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নেয় এবং জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন করে মাত্র সাতটি আসন পায়। ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে গেলে বিএনপি আবারও হাসির পাত্রে পরিণত হবে। অথবা বিএনপি নির্বাচনে গেল না, কিন্তু আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন করে ফেলল। এ ক্ষেত্রেও বিএনপি বিপাকে পড়বে।
যখই দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীলতায় নিপতিত হয় তখন অনাহারে, অর্ধাহারে থাকতে হয় খেটে খাওয়া মানুষেরই। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি। বর্তমানে দেশে বিভেদ, অনৈক্য, মতভেদের যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, তার কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস। এ অনাস্থা, অবিশ্বাস অনেক দিন ধরেই চলছে। এত দিনে এর অবসান হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু হয়নি।
সাংবাদিক
abunoman1972@gmail.com