মোজাহিদ হোসেন : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র ও সুশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গণতন্ত্র নিশ্চিত করে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বচ্ছ নির্বাচন ও ন্যায়বিচার, যা দেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে সুশাসন জনগণের অধিকার সংরক্ষণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও কার্যকর প্রশাসন গঠনে সহায়তা করে।
উন্নয়ন বলতে বোঝায় বিদ্যমান অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন। উন্নয়ন হলো সমৃদ্ধি বা সার্বিক মানোন্নয়ন। দেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা যায়।
দেশের উন্নয়ন বলতে একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও নাগরিকদের জীবনমানের উন্নতিকে বোঝায়। এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক দেশ। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় পদ্ধতির। এই পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রীর হাতে সরকারের প্রধান ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। প্রধানমন্ত্রী হলো সরকারের মধ্যমণি। বহুদলীয় গণতন্ত্র পদ্ধতিতে এখানে জনগণের সরাসরি ভোটে জাতীয় সংসদের সদস্যরা নির্বাচিত হন।
এখানে সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। গণতন্ত্র বলতে কোনো জাতিরাষ্ট্রের (অথবা কোনো সংগঠনের) এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে অ্যাথেন্স ও অন্যান্য গ্রিক নগররাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহররাষ্ট্র এথেন্সে। আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর তার দেয়া পেনসিলভানিয়া স্টেটের গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে-‘ড়োবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব.’ যার অর্থ হলোÑগণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য পরিচালিত হয়।
সুশাসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ড়েড়ফ ড়োবৎহধহপব, যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো ভালো বা সুন্দর শাসনব্যবস্থা। সুশাসন একটিমাত্র শব্দ হলেও এককথায় সুশাসনকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কারণ সুশাসন শব্দের মধ্যে বহুমাত্রিক ধারণা বিদ্যমান।
সুশাসন বলতে এমন এক আদর্শ শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়, যা একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, আইনের শাসন ও মানবাধিকার সুশাসনের মূলনীতি হিসেবে বিবেচিত।
সুশাসন হচ্ছে কিছু বাস্তব ও গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপের সম্মিলন, যার ফলে সেই রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হয় এবং রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার রক্ষিত হয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। টেকসই উন্নয়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অংশীজনের অংশগ্রহণ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সব স্তরে নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। সেই রাষ্ট্রে স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত হয়। রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা লোপ পায়। সুশাসনের ফলে রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সুশাসনের ফলে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে কিছু অন্তরায়-১. দুর্নীতি, ২. শিক্ষা ও দক্ষতার ঘাটতি, ৩. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ৪. অবকাঠামোগত দুর্বলতা, ৫. দারিদ্র্য ও আয়বৈষম্য, ৬. জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত সমস্যা, ৭. জনসংখ্যার চাপ, এবং ৮. প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকা।
সমাধানের পথ: ১. সুশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ; ২. মানসম্মত শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; ৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ; ৪. অবকাঠামো উন্নয়ন; ৫. আয়বৈষম্য হ্রাস ও দারিদ্র্য নিরসন; ৬. পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা; ৭. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্যোগ; এবং ৮. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৬নং লক্ষ্য শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের ওপর জোর দেয়। এটি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। সরকার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রে কাজ করতে হবে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ, তথ্যের স্বচ্ছতা ও নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যৎ গড়তে পারব। বিশ্ব আজ জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অসমতা ও সামাজিক অস্থিরতার মতো জটিল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে গেলে টেকসই উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু টেকসই উন্নয়ন কেবল প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বা অর্থনৈতিক বিনিয়োগের বিষয় নয়, এর জন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান, যা গণতন্ত্র ও সুশাসনের মাধ্যমেই সম্ভব।
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়