Print Date & Time : 17 July 2025 Thursday 2:20 am

গণতান্ত্রিক জবাবদিহির ঘাটতি থাকলে বাজেট বাস্তবায়ন হয় না

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাজেটের সঠিক বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক জবাবদিহি। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার ঘাটতি থাকলে কর আহরণ ও উন্নয়ন ব্যয় উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে ভাবগাম্ভীর্য হারিয়ে বাজেট একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া বাজেটে এখন আর রাজনৈতিক উপাদান তেমন থাকে না। পুরোপুরি আমলাতন্ত্রনির্ভর বাজেট প্রণীত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের বিপুল অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন কিছু রাখা হয়নি।

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় এমন মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২০২৪: অসুবিধাগ্রস্ত মানুষেরা যা পেল’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সংস্থাটির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ড. দিবালোক সিংহ, নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য আসিফ ইব্রাহিম, ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রোগ্রাম হেড সমীর রঞ্জন নাথ ও সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।

বাজেট বাস্তবায়নের গণতান্ত্রিক জবাবদিহির গুরুত্ব উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দেশে দুটি ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার পরে দেখা গেছে দেশে রাজস্ব আহরণ হ্রাস পেয়েছে। এক্ষেত্রে এক বিশাল বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। এক দিকে সরকার কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছে, অন্যদিকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিশেষ ঘটনার পর দেশে কর আহরণ কমে যাচ্ছে। আর রাজস্ব আহরণ যদি কম থাকে, তাহলে সরকারের হাতে ব্যয় করার মতো সম্পদেরও স্বল্পতা দেখা দেবে। ফলে দেশের অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের জন্য অর্থ ব্যয়ের

সক্ষমতাও হ্রাস পাবে। এভাবে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার জায়গা দুর্বল থাকলে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।

বড় আকারের বাজেট বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকেই বলে থাকেন যে, ‘এটি বিরাট বাজেট। বাজেটটি প্রকৃত অর্থে বিশাল কিনা তা পরিমাপ করতে হলে এটিকে জিডিপির অনুপাতে তুলনা করতে হবে।’ এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি ব্যয়ের অনুপাত তুলনা করে তিনি জানান যে, একটি দেশের বাজেটকে বড় বাজেট বলতে হলে জিডিপির অনুপাতে অন্তত ৩০ শতাংশ হওয়া উচিত বাজেটের আকার। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ঘোষিত বাজেট জিডিপির ১৫ শতাংশের বেশি নয়। সুতরাং এ বিবেচনায় বাজেট কোনোভাবেই বিশাল বাজেট নয়। এর পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন, প্রস্তাবিত বাজেটের আকার যত বড় হয়, বাস্তবায়িত বাজেটের আকার তত বড় হয় না। বাজেট বাস্তবায়নের হার ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।

কর ব্যবস্থার ত্রুটির বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমানে দেমে যে রাজস্ব আহরণ হয়, তার দুই-তৃতীয়াংশই পরোক্ষ কর। সেক্ষেত্রে কারও কর দেয়ায় ক্ষমতা থাকলেও দিতে হয়, আবার না থাকলেও দিতে হয়। যার সক্ষমতা আছে সে যে কর দেয়, আর যে গরিব সেও একই হারে কর দিয়ে থাকে। এভাবে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল সমাজ সাম্যের কোনো কথা বলতে পারে না।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, দেশে দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যার অনুপাত কমছে। কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশ একটি বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। এক দিকে দারিদ্র্যে কমছে, অন্যদিকে বৈষম্য বাড়ছে। এমন দ্বৈত অবস্থা তো চলতে পারে না। তিনি বলেন, ‘সরকারের হাতে খরচ করার মতো টাকাও নেই, ডলারও নেই। তাই খরচ করার টাকা সে সংগ্রহ করতে চাচ্ছে। এখন সরকার অর্থ সংগ্রহে এক প্রকার মরিয়া। কারণ আইএমএফ বলেছে, প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, আইএমএফ থেকে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে হলে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এত চেষ্টার পরও আধা শতাংশ বর্ধিত করের লক্ষ্যমাত্রা বাজেটে প্রাক্কলন করা সম্ভব হয়নি।’

তিনি বলেন, সরকারের ডান ও বাম হাত একসঙ্গে কাজ করছে না। যেখানে বিবিএসের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশের বেশি। সেখানে অর্থ মন্ত্রণালয় আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ রাখার বিষয়ে জানিয়েছে। বর্তমান যে সংকটের মধ্যে যাচ্ছে এবং বিবিএসের তথ্য থাকার পরও অর্থ মন্ত্রণালয় এ কথা কীভাবে বলল? দুটিই সরকারেরই প্রতিষ্ঠান, কিন্তু দুটি দুরকম কথা বলছে। আর বাস্তবে তো মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে ১০ হয়ে গেছে। তার মানে বাজেটে যে মূল্যস্ফীতি দেখানো হয়েছে তা অবাস্তব। সেই সঙ্গে পুরো বাজেটকেই তিনি কল্পকথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেট প্রণয়নে রাজনীতিবিদ ও নাগরিকদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। রাজস্ব আহরণের মরিয়া চেষ্টার ফলে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে এগুলোকে রাজনৈতিক বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়েছে বলেও মনে হয় না। এটা যে নির্বাচনী বাজেট নয়। এ বাজেট আমলাতান্ত্রিকভাবে রাজস্ব আহরণের প্রয়োজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘খুবই আমলাতান্ত্রিকভাবে রাজস্ব আহরণের প্রয়োজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাজেটটি করা হয়েছে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যে পদক্ষেগুলো নেয়া হয়েছে তার অনেকগুলো পদক্ষেপ, দুই হাজার টাকা (টিনধারীদের ন্যূনতম কর) তো বটেই, সারচার্জÑএছাড়া অন্যান্য যেগুলো আছে নি¤œ মধ্যবিত্ত, অনেক সময় দরিদ্র মানুষকে প্রভাবিত করবে নেতিবাচকভাবে।’

আসিফ ইব্রাহিম বলেন, বাজেটে পুঁজিবাজারের বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। একটি দেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হলে পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই। কিন্তু সে বিষয়ে বাজেটে একটি কথাও বলা হয়নি। পাশাপাশি অর্থবিলে কর কাঠামো বিষয়ে যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে তার বেশকিছু বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তিনি মন্তব্য করেন। এক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণে সম্পদের হিসাব দাখিলের মতো প্রবিধানের সমালোচনা করেন তিনি। ড. ফাহমিদা খাতুন উল্লেখ করেন, বাজেটে জলবায়ু ও পরিবেশগত বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই। অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বাজেটের বিভিন্ন কাঠামোগত ত্রুটি তুলে ধরেন। তিনি চার ধরনের ত্রুটি চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে দুর্বলতা। এডিপিতে যেসব প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ সংশোধিত প্রকল্প বলে জানান তিনি। এক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়াতে তিনি আইএমইডির তদারকি কার্যক্রম জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।